বিশ্ব ইজতেমা শুরু আজ

স্টাফ রিপোর্টার: ধর্মপ্রাণ লাখো মুসল্লির সমাগমে এখন মুখর টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে নিজেকে সমর্পণের জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন তারা। বহু কাঙ্ক্ষিত তাবলীগ জামাত আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমা শুরু হচ্ছে আজ শুক্রবার। বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার এই প্রথম পর্ব। ১১ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে এ পর্ব শেষ হবে। মাঝে ৪ দিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হবে আগামী ১৬ জানুয়ারি।

ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরুব্বি প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন জানিয়েছেন, ইজতেমা ময়দানের প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম পর্বে অংশ গ্রহণকারী ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ময়দানে স্ব-স্ব খিত্তায় (নির্দিষ্ট বসার স্থান) এসে অবস্থান নিয়েছেন। প্রতি বছরই মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে বলে তিনি জানান।

বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। প্রস্তুতি দেখতে গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ইজতেমা ময়দান পরিদর্শন করেন রেলপথ মন্ত্রী মো. মুজিবুল হক, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এমপি, স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল, ৱ্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ প্রমুখ।

এদিকে গতকালও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস-ট্রাক, ট্রেন ও লঞ্চযোগে মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে এসে সমবেত হচ্ছেন। মানুষের এ স্রোত আখেরি মোনাজাতের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তবে দেশব্যাপি অবরোধ থাকায় ইজতেমায় আসতে ভোগান্তি পোয়াতে হচ্ছে বলে অনেক মুসল্লি অভিযোগ করেছেন।

গতকাল ইজতেমা ময়দানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে জড়ো হচ্ছেন। ইজতেমা ময়দান ও এর আশেপাশে যেদিকে চোখ যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পড়া মুসল্লিদের দেখা মেলে। যেন ইবাদত-বন্দেগীর নগরীতে পরিণত হয়েছে টঙ্গী। এবার বিশ্বের ১১৫টি দেশ থেকে প্রায় ১৭ হাজার বিদেশি মেহমান আসার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে এক হাজারেরও বেশি মেহমান ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে অবস্থান করছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫ লক্ষাধিক মুসল্লি­ ময়দানে তাদের জন্য নির্ধারিত বিভিন্ন খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল রয়েছেন। আজ শুক্রবার থেকে আম বয়ান শুরু হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার বাদ আসর থেকেই খিত্তায় অবস্থানকারী মুসল্লিদের উদ্দেশে বয়ান শুরু হয়েছে। প্রথমে বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. রবিউল ইসলাম। বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আহমেদ লাট।

পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা: বিশ্ব ইজতেমা ময়দান ও এর আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৫ স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছেন। গতকাল সকাল থেকেই ইজতেমা এলাকার আকাশে দফায় দফায় ৱ্যাবের হেলিকপ্টারের টহল শুরু হয়েছে। দুপুরে ইজতেমা ময়দানে আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে ৱ্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, অবরোধের মাঝে ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের কোনো গাড়ি কোথাও সমস্যায় পড়লে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আমাদের জানালে আমরা তাদের নিয়ে আসতে সহযোগিতা করবো। সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গতকাল থেকেই পুলিশসহ ৱ্যাব, সাদা পোশাকধারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ ১২ হাজার আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করতে র্যাবের কমিউনিকেশন উইংয়ের পক্ষ থেকে ১৮টি প্রবেশপথসহ চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হয়েছে ৬০টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। এছাড়াও থাকছে মেটাল ডিটেক্টর, বাইনোকুলার, নাইটভিশন গগল্স ও র্যাবের ষ্ট্রাইকিং ফোর্স। র্যাবের ইন্টেলিজেন্সের সদস্যরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ ইজতেমা মাঠে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি রাখছেন। প্রতিটি খিত্তায় বিশেষ টুপি পরিহিত ও সাদা পোশাকধারী ২ জন করে গোয়েন্দা সদস্য অবস্থান করছেন।

গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান: বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের যানবাহন পার্কিংয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করেছে ট্রাফিক বিভাগ। ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য উত্তরা রাজউক কলেজের আশেপাশে এবং ৬ ও ৭ নং সেক্টর, সিলেট বিভাগ উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর, বরিশাল বিভাগ ধউর ব্রিজ ক্রসিং সংলগ্ন আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের খালি জায়গা, ঢাকা বিভাগ উত্তরা সোনারগাঁও জনপথ সড়কের পূর্ব হতে পশ্চিম মাথা, খুলনা বিভাগ উত্তরা ১০ ও ১১নং সেক্টরের সড়কের উভয়পাশে, রংপুর বিভাগ প্রত্যাশা হাউজিং, চট্টগ্রাম বিভাগ গাউসুল আজম এভিনিউ, রাজশাহী বিভাগ কামারপাড়া হাউজিং মাঠ ও উত্তরা ১০নং সেক্টরের খালি জায়গা, ঢাকা জেলা আশুলিয়া কলেজ ও আশুলিয়া হাইস্কুল মাঠ, গাজীপুর জেলার জন্য টঙ্গীর কে-২/নেভি সিগারেট ফ্যাক্টরির পাশে, কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল প্রাঙ্গণ, মেঘনা টেক্সটাইল মিল সংলগ্ন রাস্তার উভয় পাশে, সফিউদ্দিন সরকার একাডেমী মাঠ, টিআইসি মাঠ, জয়দেবপুর- চৌরাস্তা ট্রাকস্ট্যান্ড, চান্দনা-হাইস্কুল মাঠ ও ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠ।

পার্কিং নিষেধ: ঢাকার মহাখালি ক্রসিং থেকে টঙ্গী হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশ, উত্তরার আব্দুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল রাস্তার দুইপাশ, প্রগতি সরণিস্থ মধ্যবাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রগতি সরণিস্থ সড়কের দু পাশ।

ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প: বিশ্ব ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে গতকাল ময়দানের আশেপাশে স্থাপিত বিভিন্ন চিকিত্সা কেন্দ্র উদ্বোধন করেন রেলপথ মন্ত্রী মো. মুজিবুল হক। টঙ্গীর মুন্নু নগর এলাকায় হামদর্দ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক ইউনানী হারবাল মেডিকেল সোসাইটি, জাতীয় ইমাম সমিতি, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইবনে সিনা, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও টঙ্গী থানা প্রেসক্লাব ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পে মুসল্লিদের চিকিত্সা সেবা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বেক্সিমকো, স্কয়ার ও টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি তাদের স্টলে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করছে। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা পর্যন্ত টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ৫৩৮ জন মুসল্লি চিকিত্সা সেবা নিয়েছেন।

পরিচ্ছন্নতা অভিযান: গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মজিবুর রহমান কাজল জানান, করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাস্তার ধুলাবালি রোধ করার জন্য প্রতিদিন পানি ছিটানো হচ্ছে। মশা নিধনের জন্য ২০টি ফগার মেশিনে মশানাশক ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে ৭০ ড্রাম ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হবে।

ভ্রাম্যমাণ আদালত: বিশ্ব ইজতেমায় ম্যাজিস্ট্রিয়াল দায়িত্বপালনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনগত নির্দেশনা প্রদান করতে ৪টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ ভ্রাম্যমাণ আদালতের দায়িত্ব পালন করবেন। ৮ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পালাক্রমে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোলরুমের দুটি টেলিফোন নম্বর রয়েছে। এগুলো হলো- ৯৮১৩৪০১ ও ৯৮১৩৪০২।

সার্বক্ষণিক বিদ্যুত: উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রিড ও টঙ্গী নিউ গ্রিড থেকে ১১ কেভির ৫টি ফিডারের মাধ্যমে ইজতেমা এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুত সরবরাহ করা হবে। এছাড়া ৪টি স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর এবং ৫টি ট্রলি-মাউন্টেড ট্রান্সফরমারও রাখা হবে।

বাস ও ট্রেন সার্ভিস: বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে এ বছরও বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) বিশেষ ট্রেন ও বাস চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা অভিমুখি সকল ট্রেন টঙ্গী রেলস্টেশনে ২ মিনিট বিরতি দেবে। আখেরি মোনাজাতের পরের দিন টিকেটধারী মুসল্লিরা যাতে উঠতে পারেন সেজন্য সুন্দরবন, পারাবত, উপকূল, এগারসিন্ধুর, একতা, অগ্নিবীণা, নীলসাগর, জয়ন্তিকা, সিল্কসিটি, পদ্মা ও মহানগর গোধূলি ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে ২ মিনিট বিরতি দেবে।

এছাড়া রাজধানীর গুলিস্থান, ফুলবাড়িয়া, কমলাপুর, মতিঝিল, ফার্মগেট, গাবতলী, মহাখালী, আজিমপুর থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করেছে বিআরটিসি। ২য় পর্বের আখেরি মোনাজাত পর্যন্ত কাকরাইল মসজিদ সংলগ্ন পয়েন্ট থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত দোতলা বাস চলাচল করবে। বিমানবন্দর থেকে বিদেশি মুসল্লিদের ইজতেমাস্থলে নিয়ে যাওয়ার জন্যও বাস থাকবে।

অবরোধ বন্ধের আহবান: ইজতেমার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অবরোধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। গতকাল বৃহস্পতিবার বায়তুল মোকাররমে ফাউন্ডেশনের এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ আহ্বান জানানো হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন ফাউন্ডেশন বোর্ডের গভর্নর শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ। উপস্থিত ছিলেন ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য মেজবাহ-উর রহমান, মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ।