বিশুদ্ধ পানির সংকটে ঝুঁকিতে বাংলাদেশ : বিশ্ব পানি দিবস আজ

 

স্টাফ রিপোর্টার: নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাড়ে নয় কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে পারছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এ তথ্য জানিয়ে বলছে, বাংলাদেশের মানুষ ঝুঁকির মধ্যে বাস করছে। কারণ ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ৯৭ ভাগ মানুষের পানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হলেও বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং মরসুম ভেদে পানি সঙ্কটের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। শিল্পোন্নয়ন ও কৃষিকাজও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই বাস্তবতায় আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পানি দিবস’।

বিশ্ব পানি দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পানি এবং কর্মসংস্থান’। জাতিসংঘ বলছে, বিশুদ্ধ পানি ভাল কর্মসংস্থানের সুযোগ এনে দেয়। এক হিসাবে দেখা যায়, পৃথিবীতে ১৫ কোটি মানুষ পানি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত।

দূষিত পানি পান করার ফলে সম্প্রতি ভয়াবহ হারে বেড়েছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসের মতো মারাত্মক ব্যাধির উৎস থাকে দূষিত পানি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অভিমত, দূষিত পানি দীর্ঘদিন পান করতে থাকলে আরো জটিল রোগ, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। কিডনি রোগ, আলসার, রক্তচাপ, অ্যাজমা, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে।

রাজধানী ঢাকায় দৈনিক পানির দরকার হয় ২২০ থেকে ২৩০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসা (ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড সুয়্যারেজ অথরিটি) চাহিদার পুরোটাই সরবরাহও করে। তবে বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘসময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহকৃত পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না, তা পানযোগ্যও করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহকৃত পানির ১৫ শতাংশ আসে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা থেকে পানি এনে এখানে শোধন করা হয়। কিন্তু নদী দুটির পানি এতটাই দূষিত যে তা শোধন করেও পানযোগ্য করা যাচ্ছে না। ওই পানি মূল শোধনাগারে নেয়ার আগে প্রাক-শোধনাগারে নিয়ে একবার শোধন করতে হয়। বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যক্তিরা করছে রমরমা বাণিজ্য। বোতলজাত পানি অথবা জেরি-ক্যান বিক্রি এখন ব্যাপক হারে বেড়েছে। কিন্তু রাজধানীসহ সারাদেশে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা জেরি-ক্যানে করে যে পানি বিক্রি করে তার বেশিরভাগই বিশুদ্ধ নয়।

বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর পানির উত্স ভারত থেকে বয়ে আসা অভিন্ন নদীগুলোর পানি। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ এবং পানি প্রাপ্যতা ভয়াবহভাবে কমেছে। মানুষের পানি প্রাপ্যতা এবং অপ্রাপ্যতাও ঋতুভেদে ওঠানামা করে। বর্ষায় পানির ঢল থাকলেও  গ্রীষ্ম  ও শীত মরসুমে পানির প্রাপ্যতা কমে যায়। এর প্রধান কারণ, বাংলাদেশের কোনো নদীই বর্ষার সব পানি ধরে রাখতে পারে না। গ্রীষ্মে পানিপ্রবাহ কমে আসায় সমুদ্রের পানি উঠে আসছে উজানে। বৃদ্ধি পাচ্ছে জমিতে লবণাক্ততা।

অপরদিকে, পানির চাহিদা মেটাতে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন বাড়ছে। এতে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১০ সালে বিশ্বে যে ১৫টি দেশ সবচেয়ে বেশি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তার মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ইরানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশে ২০১০ সালে ৩০.২১ কিউবিক কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ৮৬ শতাংশ সেচ কাজে, ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি এবং মাত্র ১ শতাংশ শিল্পে ব্যবহূত হয়।

ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনে পরিবেশ বিপর্যয়: নদীতে পানিপ্রবাহ না থাকায় শহর অঞ্চলে ও কৃষিকাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। জানা গেছে, রাজধানীর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান চাহিদার চাপে সুপেয় পানি সরবরাহ করতে গিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করতে বাধ্য হচ্ছে ঢাকা ওয়াসা।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ঢাকার ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের কোনো কোনো জায়গায় প্রতিবছর দুই থেকে তিন মিটার পানি নেমে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ায় যেমন পরিবেশ ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তেমনি বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার অন্যান্য নদীর দূষিত পানি এই পানির স্তরে প্রবেশ করছে। এতে ঢাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর তিন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এক. পানি নিচে নেমে যাওয়ায় যেমন জলের উত্স হারানো, দুই. ভূ-গর্ভের পানি দূষিত হয়ে তা এই পানির ব্যবহারকারীদের মাঝে রোগ ছড়ানো, তিন. পরিবেশ বিপর্যয় ও ভূমিকম্পের সম্ভাবনা। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং খুলনা বিভাগে কৃষিকাজের জন্য গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে অতি মাত্রায় পানি আহরণ করা হচ্ছে। সেখানে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ার কারণে শুকনো মৌসুমে নদীর প্রবাহ দ্রুত শুকিয়ে যায়। ফলে পুকুর, জলাশয় এবং হস্তচালিত নলকূপ থেকে সাধারণ মানুষ তার প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে পারে না।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এরমধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা ১১৭টি। অনেকের মতে, নামবিচারে বাংলাদেশে ছোট-বড় নদী রয়েছে প্রায় ৬০০টি। এর মধ্যে ৫৭টি নদী আন্তর্জাতিক। ৫৪টির উত্সস্থল ভারত এবং বাকি ৩টির মিয়ানমারে। ২০ বছর আগেও মৃত নদীর সংখ্যা ছিল অর্ধেক। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার নদীপথ নাব্যতা হারিয়েছে।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস সিইজিআইজিএস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ছোট ছোট আরো শত শত নদীর হিসাব না পাওয়া গেলেও গত ৪০ বছরে শুধুমাত্র তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনাতেই বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। আর তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর। প্রতি বছর কোনো না কোনো নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনগুলোতে আরো দ্রুতহারে নদী বিলুপ্ত হতে থাকবে। পানি সঙ্কট আরো ভয়াবহ হবে।