বিশাল ব্যয়ের বাজেট ঘোষণা : থাকছে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

 

স্টাফ রিপোর্টার: উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা অব্যাহত রাখার স্বপ্ন দেখিয়ে ঘোষণা করা হলো আগামী অর্থবছরের বাজেট। সময় এখন আমাদের এমন স্লোগানকে সামনে রেখে বিশাল ব্যয়ের প্রাক্কলন দেখানো হয়েছে প্রস্তাবিত এই বাজেটে। বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টায় জাতীয় সংসদে আকার বৃদ্ধির ধারাবাহিকতার বাজেট ঘোষণা দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিভিন্ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হলেও কার্যত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পরিকল্পনা তার। বড় ব্যয়ের বাজেট মনে হলেও অনুন্নয়ন খাতেই চলে যাবে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।

উন্নয়ন বরাদ্দ চলতি বাজেটের তুলনায় বাড়লেও অর্থ সংস্থানের চ্যালেঞ্জ রয়ে যাওয়ায় তার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থাকছে। যদিও অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আদায় জোরদার করতে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া ভ্যাট আইনের খড়গ সাধারণের ওপর পড়ছে। ব্যাপকভাবে ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি এবং ১৫ শতাংশে অটল থাকায় ভ্যাট খাত থেকে ৯১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। এই খাতে বিশেষ নজর দেওয়ায় সাম্প্রতিককালে ভ্যাট থেকেই আদায়ের পরিমাণ বাড়ছে। রাজস্ব আদায়ের অন্যান্য খাত যেমন আয়কর, শুল্কাদিসহ মোট ভ্যাট—ট্যাক্স বাবদ জনগণের কাছ থেকে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা আদায় করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ভ্যাটের আওতা থেকে বাদ যায়নি ওষুধ খাতও। ১৬শ’ ৬৬ পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যা চাপে ফেলবে ভোক্তাদের। ভ্যাটের হার নিয়ে নানা বিতর্কের পর বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে নির্বাচিত কিছু খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে আইনটি কার্যকর হলে যেকোনো সময় আদেশ জারির মাধ্যমে এই অব্যাহতি প্রত্যাহার করার ক্ষমতা রাজস্ব বোর্ডের থাকছে। ভ্যাটের পাশাপাশি শুল্কহারেও কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছে। বসানো হয়েছে সম্পূরক শুল্ক। তবে দেশীয় কিছু উত্পাদনমুখী খাতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বাড়িয়ে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বাড়ানো হয়েছে আবগারী শুল্ক। ব্যাংকের ছোট আমানতের ওপরও কর বাড়িয়ে জনগণের টাকায় ভাগ বসানো হয়েছে। এক লাখ টাকা কিংবা তার বেশি অর্থ থাকলেই বাড়তি আবগারী শুল্ক দিতে হবে। যা ব্যাংকে টাকা রাখতে গ্রাহকদের নিরুত্সাহিত করবে। কমবে সঞ্চয় প্রবণতা।

অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, এক লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংকে থাকলে বছরে ৮শ’ টাকা কেটে নেওয়া হবে। এর বেশি পরিমাণ অর্থের জন্য বেশি হারে কর্তনযোগ্য হবে। বিমান ভ্রমণেও সার্কভুক্ত দেশ ছাড়া অন্য এশীয় দেশের জন্য বিদ্যমান এক হাজার টাকার বদলে দুই হাজার টাকা, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দেড় হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এটি করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রসারণমূলক কর পরিধি ও ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পাবে- যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতায় চাপ ফেলবে। জাতীয় নির্বাচন ইস্যুকেও অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতার শুরুতে এনেছেন। বলেছেন, ‘আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন হওয়ায় বাজেটে নতুন কোনো দিকনির্দেশনার সুযোগ কম থাকবে। সেক্ষেত্রে এই বাজেটেও তেমন দিকনির্দেশনা নেই বললেই চলে। বরং বিভিন্ন খাতে বিগত সময়ের নেওয়া পদক্ষেপের কথা উঠে এসেছে বেশি। পদ্মা সেতু ছাড়া অন্য মেগা প্রকল্প নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু ছিলো না তার বাজেট বক্তৃতায়। নানা খাতে করহার বাড়ানোর প্রক্ষেপণ করলেও অনুন্নয়ন ব্যয় মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উত্স থেকে ঋণ নিতেই হবে। ঘাটতির ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা পূরণ করতে হবে ঋণ ও অনুদান খাত থেকে। এরফলে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর চাপ পড়বে। ফল হবে বেসরকারি খাতে পুঁজির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া। তাহলে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে যে পরিমাণ বিনিয়োগের দরকার হবে, তা স্বপ্নই রয়ে যাবে।

আয়ব্যয়ের প্রাক্কলন: আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর বাবদ আদায়ের লক্ষ্য ২ লাখ ৫৬ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। এরমধ্যে আয় ও কর্পোরেট কর বাবদ ৮৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা, আমদানি ও রফতানি শুল্কবাবদ ৩০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক বাবদ ৩৮ হাজার ২১২ কোটি টাকা আদায় করা হবে আগামী বছর। রাজস্ব বহির্ভূত অন্যান্য করতো রয়েছেই। রাজস্ব আদায় বাড়াতে সব ধরনের রফতানি খাতে উেস কর হার দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে প্রায় ৮শ কোটি টাকার মত বাড়তি আদায় সম্ভব হবে।

উন্নয়ন বরাদ্দ: প্রস্তাবিত বাজেটটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ১৪ তম বাজেট। এই বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ রাখা হয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়া, কৃষিতে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, স্বাস্থ্য ৬ দশমিক ১ শতাংশ, জনপ্রশাসন ৩ দশমিক ১ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, অন্যান্য খাতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের ঘোষণা দেওয়া হয়।

অর্থায়নের উত্স: মোট বাজেটের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৬২ শতাংশ অর্থায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে আসবে ২ দশমিক ১ শতাংশ এবং কর ব্যতিত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ ঋণ পাওয়ার লক্ষ্য ১৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে প্রাপ্তির উত্স ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ ১ দশমিক ৪ শতাংশ।

সংশোধিত বাজেট: নতুন বাজেট পেশের সঙ্গে চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটও উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। চলতি বছরের জন্য ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হলেও তা সংশোধন করে ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়। এই বাজেটের সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়ায় ৯৮ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।