বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল : রাজ্যে রাজ্যে বিক্ষোভে অশান্ত ভারত

আসামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫ : বিভিন্ন অঞ্চলে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ
ভারতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিলের (সিএবি) প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পাঞ্জাবসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে। কারফিউ, সেনা, পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর প্রতিরোধ উপেক্ষা করে শুক্রবারও বিভিন্ন স্থানে মিছিল, সড়ক অবরোধ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এদিন মেঘালয়েও কারফিউ জারি করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার আসামে কারফিউ ভেঙে রাস্তায় নামে হাজারও জনতা। তাদের রুখতে গুলি চালায় পুলিশ। এতে তিনজন নিহত ও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গত কয়েকদিনের এই আন্দোলনে আসামে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ জনে। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, মৃতের সংখ্যা তিনজন। বিক্ষোভ দমাতে বিভিন্ন রাজ্যে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও এসএমএস সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার রাতে বিলটিতে সই করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। ফলে এটি আইনে পরিণত হয়েছে। যদিও আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করেছেন তৃণমূলের একজন এমপি। পশ্চিমবঙ্গের পর কেরালা ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীরাও ঘোষণা দিয়েছেন তাদের রাজ্যে এ বিতর্কিত আইন কার্যকর করা হবে না। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও আইনটির বিরোধিতা করেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দফতর। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারত সফর স্থগিত করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। খবর পিটিআই, এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও আনন্দবাজারের। শুক্রবার সকাল থেকে মেঘালয়ে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও এসএমএস সার্ভিস দুই দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের বিভিন্ন এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাজ্যে বিক্ষোভ ও সহিংসতার পর এই কারফিউ জারি করা হয়। মেঘালয় পুলিশ টুইটে কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধের ঘোষণা দেয়। শিলংয়ে স্থানীয় লোকজনের করা মোবাইল ফোনের ভিডিওতে দেখা গেছে, কমপক্ষে দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এলাকার প্রধান শপিং স্ট্রিটে পুলিশ নামার পর হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। টুইটারে পোস্ট করা আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, এলাকার প্রধান দুটি সড়কে মশাল নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়েছে। শিলং থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে উইলিয়ামনগর এলাকায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমার জনসভায় তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির সামনে ‘কনরাড ফেরত যাও’ স্লোগান লেখা ব্যানার নিয়ে মানুষ বিক্ষোভ করে। আসামে বিক্ষুব্ধ জনতা বিভিন্ন যানবাহন ও সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ করেছে। রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে তারা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে দু’জন নিহত হন। আসামের তিনসুকিয়ায় আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে নারায়ণ নামে এক বৃদ্ধের। তিনি বাঙালি মালিকানাধীন একটি হোটেলে কাজ করতেন। বিক্ষোভকারীরা হোটেলে আগুন দিলে তার মৃত্যু হয়। তবে এদিন ত্রিপুরায় বড় ধরনের সহিংস কোনো বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে শুক্রবার বিক্ষোভে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে কলকাতার উলুবেড়িয়া স্টেশন চত্বর। দুপুর থেকে উলুবেড়িয়া স্টেশনে আপ ও ডাউন লাইনে ট্রেন অবরোধে শামিল হন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় ট্রেন লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোড়া হয় এবং লাইনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রেল সূত্রে জানা যাচ্ছে, উলুবেড়িয়া স্টেশনে এদিন ভাংচুরও চালান বিক্ষোভকারীরা। রেল অবরোধের জেরে হাওড়া-খড়গপুর শাখায় বিপর্যস্ত হয় ট্রেন চলাচল। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন অফিস ফেরত যাত্রীরা। এদিন হামলার মুখে পড়েন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু। পূর্ব মেদিনীপুরের ভূপতিনগরে হামলা করা হয় সায়ন্তনের কনভয়ে। ব্যাপক ভাংচুর চালানো হল বিজেপি নেতার গাড়িতেও। ১৯৫৫ সালের ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে এই সংশোধনের ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে চলে আসা হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন।

সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের : এদিকে সিএবি পাস হওয়ার পর মোদি সরকারকে কড়া বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। ওই বার্তায় ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় মোদি সরকারকে সচেষ্ট হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ঘিরে কী কী ঘটছে, সেদিকে নজর রেখেছি আমরা। ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সকলের সমানাধিকারই আমাদের দুই গণতন্ত্রের মৌলিক নীতি। ভারতের কাছে মার্কিন সরকারের আহ্বান, সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা মাথায় রেখে তারা যেন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করে।’

শুরু থেকেই এই বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে মার্কিন কংগ্রেসের একটি অংশ। জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) পর দেশের সংখ্যালঘুকে নিশানা করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মোদি সরকার নাগরিক সংশোধনী বিল এনেছে বলে দাবি তাদের। তা নিয়ে সপ্তাহের শুরুতেই নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের বিরুদ্ধে সরব হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)। তারা জানায়, নাগরিকত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মানদ- বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বিপজ্জনক। সংসদের দুই কক্ষে বিলটি পাস হলে অমিত শাহসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো উচিত বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কাছে সুপারিশও করে তারা।

গণআন্দোলনের ডাক মমতার : নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ছাড়া সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসহ সাধারণ মানুষকে আগামী সোমবার থেকে কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিলে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। ওই দিন বেলা ১টায় আম্বেদকরের মূর্তির পাদদেশ থেকে মিছিল শুরু হয়ে শেষ হবে জোড়াসাঁকোতে। পরদিন মঙ্গলবার মিছিল শুরু হবে দক্ষিণ কলকাতায় যাদবপুরের ৮বি বাসস্ট্যান্ড থেকে, শেষ হবে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে গিয়ে। একইভাবে বুধবারও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

এর আগে শুক্রবার দিঘায় মমতা বলেন, কোনো এনআরসি নয়, কোনো ক্যাব (সিএবি) নয়। আইন পাস হলেও আমাদের সরকার তা কার্যকর করবে না। সবাইকে বলছি, ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করুন। সব রাজ্যে গণআন্দোলন করুন। বাংলাতেও গণআন্দোলন গড়ে তুলুন। মমতার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী এবং কেরালার মুখ্যমন্ত্রীও। যে কোনো মূল্যে নাগরিকত্ব বিল তাদের রাজ্যে আটকানো হবে বলে জানিয়েছেন তারা। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমারিন্দর সিং বলেছেন, এই বিল অসাংবিধানিক। পাঞ্জাবে এই বিল আটকাতে প্রয়োজনে আইন পাস করা হবে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও বলেছেন, সংবিধানের দেয়া অধিকার খর্বকারী নাগরিত্ব সংশোধনী বিল কোনোমতেই কেরালা সরকার কার্যকর করতে দেবে না।

নাগরিকত্ব আইনকে চ্যালেঞ্জ : ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনটির সাংবিধানিক ভিত্তি চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র। তৃণমূল সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র আইনটিকে ভারতীয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দেশের শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। শুক্রবার মামলাটি করার পর তিনি মামলার জরুরি শুনানির আবেদন করেন। তবে তৃণমূল সংসদ সদস্যদের মামলাটি সুপ্রিমকোর্টে গৃহীত হলেও জরুরি ভিত্তিতে শুনানির আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।