বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকাই মঙ্গল

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যত কম হবে, ততই বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গল হবে। গতকাল শনিবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে আজীবন সম্মাননা দিতে বাংলাদেশ মহিলা জাজ অ্যাসোসিয়েশন ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানে বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে আমি বলব, আমাদের দেশে মামলা অনুপাতে, মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিচারকের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশে মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারক নিয়োগের বিধান আছে, আইন আছে। ভারতের তুলনায় আমাদের বিচারক অর্ধেক। হাইকোর্টে সংখ্যা তো আরও খারাপ অবস্থা। আমাদের একটি রেওয়াজ চলে এসেছে। রাজনৈতিক সরকার চলে আসলেই তারা যেহেতু আমাদের সংখ্যা নেই, ইচ্ছামতো বিচারক নিয়োগ দেয়। কিন্তু এটিও ঠিক না। আমাদের হয়তো সময় চলে এসেছে, হাইকোর্টে নির্দিষ্ট করে এতোজন বিচারক থাকবেন, আপিল বিভাগে এতজন বিচারক থাকবেন। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা যদি হয়, তারপর কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমে যায়। বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যত কম হবে, ততই বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন, সেখানে নয়জন বিচারক। এখন ইচ্ছা করেও সরকার নয়জনের বেশি দিতে পারছে না। এটা কনভেনশনে চলে এসেছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সংখ্যা নির্ধারিত আছে ৩১ বিচারক। এর বেশি সরকার ইচ্ছা করলেও পারে না। আমাদের এখানে একবার ১১ জন নিয়ে দিলাম। সংখ্যা কমতে কমতে আজকে ছয়জন আছি। সামনের দিকে হয়তো চারজনে চলে যাবে। তিনি আপিল বিভাগে অন্তত তিনজন বিচারক নিয়োগ করার জন্য আবেদন জানান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বিচারকদের স্বল্পতা, অবকাঠামো স্বল্পতাসহ বিচার বিভাগের নানা দৈন্য ও দুর্দশার দিকগুলো তুলে ধরেন। সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের কাঠামো প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের মূল যে হাইকোর্ট ভবন, তাতে এই বৃষ্টির দিনে পানি চুষে একেবারে আমি যে চেয়ারে বসি, সেখানে পানি পড়ে। আমি যে চেম্বারে বসি, সেখানে পানি পড়ে। আদালত ভবনের রেকর্ড রুমে পানি পড়ে। চিন্তাভাবনা করে সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রসারণের একটি প্রকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। সে অনুপাতে ২০ তলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবনের জন্য। আমাদের যারা বিচারক আছেন, তারা ওই ভবনে বারান্দায় চেম্বার করেন। ৪০-৪৫ জনের বেশি বিচারকের চেম্বার নেই। এখন তাদের বারান্দায় বসতে হয়। আমাদের মহিলা বিচারক ও কর্মচারী আছেন। তাদের শিশুসন্তানদের রাখার জন্য কোনো সেন্টার নেই। নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থাও দিতে পারছি না। এ বিবেচনায় একটি প্রশাসনিক ভবনের প্রস্তাব করি। সে প্রস্তাব প্রি একনেকে পাস করানোর পরে একনেকে গিয়ে অজ্ঞাত কারণে ফেরত পাঠানো হয়। আমরা ২০০৯ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টে আরেকটি বর্ধিত ভবন করার জন্য চেষ্টা করে আসছি। কোনো অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত সেটি একনেকে ঘোরাঘুরি করছে। এটি আর মুখ দেখেনি। এখন অসুবিধা হচ্ছে, ওই ভঙ্গুর অবস্থার জন্য একটি কমিটি করা হয়। এ সুপ্রিম কোর্ট ভবন সর্বোচ্চ হলে পাঁচ-ছয় বছরে ভেঙে যাবে। এটি যদি ভেঙে পড়ে, আমাদের কী অবস্থা হবে, বলা মুশকিল। আমাদের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রেকর্ড রুম ওই ভবনে অবস্থিত।
বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার কাছে আমি অনুরোধ করব ২০ তলাবিশিষ্ট যে প্রশাসনিক ভবনটির জন্য নকশা, পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে, এটি একনেকে পরবর্তী যেকোনো সভায় পাস করানোর জন্য। এ সময় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা দেশ এবং বিচার বিভাগের ইতিহাসের অংশ। তিনি এ দেশের বিচার বিভাগের অহংকার। তাকে অনুসরণ করে অনেক নারী এ পেশায় এসেছেন। আজ তাই দেশে ২৪ শতাংশ নারী বিচারক রয়েছেন। অনুষ্ঠানে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘আমি আমার বিচারিক জীবনে ন্যায়বিচার করে গেছি। কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা অবহেলায় ভুল বিচার করিনি।
নারী বিচারকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রিয় নারী বিচারকরা, মনে রাখবেন বিচারকের জীবন মানেই ন্যায়বিচারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়া। আর এ দায়িত্ব পালন করা খুব কঠিন ও পরিশ্রমের। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে উচ্চ আদালতে নারী বিচারপতির সংখ্যা বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।