বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের ডাকা টানা অবোরধের ১০ দিন : পরিবহন খাতে ক্ষতি দু হাজার কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের ১০ দিনে শুধু পরিবহন খাতে দু হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখায় দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে কম-বেশি দুশ কোটি টাকা। অবরোধকারীদের হামলায় গত দশ দিনে ১৭১ গাড়িতে অংগ্নিসংযোগ, প্রায় চারশ গাড়ি ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। মারা গেছেন ১৪ পরিবহন শ্রমিক। অবরোধে সারাদেশে দু লাখের বেশি বাস-ট্রাক অলসভাবে পড়ে আছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। অবরোধ ও হরতালে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ এবং শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। এতে বক্তারা পরিবহন খাতকে অবরোধের আওতামুক্ত রাখা, গাড়ির ওপর হামলা বন্ধ, সড়ক-মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানান। হামলা বন্ধ না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সড়ক বন্ধ করে দিয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ওই মিছিল-সমাবেশ করে। পরিবহন মালিকদের মতে, গাড়ির চাকা না ঘোরায় প্রতিদিনের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে পরিবহন খাতে খরচ অব্যাহত রয়েছে। চালক ও হেলপারদের খোরাকি দিতে হচ্ছে। পাশাপাশি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদ। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। নির্ধারিত সময়ে ব্যাংকের কিস্তির টাকা শোধ করতে না পারায় মামলার আশঙ্কায় রয়েছেন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরপূর্তির দিন ৫ জানুয়ারি বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৪ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে অঘোষিতভাবে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন বিকেল থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের কারণে কার্যত আন্তঃজেলা বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। পরিবহন খাতের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, সারাদেশে বাস-ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রয়েছে তিন লাখ। সাধারণ সময়ে প্রতিদিন আড়াই লাখ বাস-ট্রাক চলাচল করে। প্রতিটি গাড়ি থেকে গড়ে ৮ হাজার টাকা আয় ধরা হলে দৈনিক ২০০ কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মালিকরা। এছাড়া প্রতিদিনই অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। ফলে সব মিলিয়ে আড়াইশ থেকে তিনশ কোটি টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন মালিকরা। এ পরিবহন নেতার তথ্য অনুযায়ী, ১০ দিনে তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন মালিকরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতিসমূহের ফেডারেশন এফবিসিসিআই ১০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, টানা অবরোধের কারণে কেবল পরিবহন খাতেই প্রতিদিন গড়ে ২শ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসেবেও গত দশ দিনে ক্ষতি হয়েছে দু হাজার কোটি টাকা। দূরপাল্লার রুটে গাড়ি চলাচল করে এমন একটি বড় কোম্পানির মালিক বলেন, হাইওয়ে চলাচলকারী নতুন নন-এসি গাড়ির দাম ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা এবং এসি গাড়ির দাম এক থেকে আড়াই কোটি টাকা। আগুনে ভস্মীভূত হলে ওই গাড়ি চলাচলের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। আগুনে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ও ভাঙচুরের শিকার হলে মেরামতে কয়েক লাখ টাকা খরচ পড়ে। তবে ছোট গাড়ির দাম ও মেরামত খরচ অনেক কম। হামলার শিকার গাড়ির প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হামলায় অল্প ক্ষয়ক্ষতির শিকার গাড়িগুলো আইনি ঝামেলা এড়াতে থানায় রিপোর্ট করে না। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির খবর গণমাধ্যমে আসে না। তবে যেসব গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, সেগুলো থানায় মামলা বা জিডি করে থাকে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, ১৪ জানুয়ারি ২০ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সারাদেশে অবরোধের প্রথম দিন ৬ জানুয়ারি ১৬, ৭ জানুয়ারি ১৪, ৮ জানুয়ারি ১৪, ৯ জানুয়ারি ১৪, ১০ জানুয়ারি ২২, ১১ জানুয়ারি ২০, ১২ জানুয়ারি ২০ ও ১৩ জানুয়ারি ১১টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদা উপজেলার কাপাসডাঙ্গা থেকে ঢাকাগামী পূর্বাশা পরিবহনের একটি বাসে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় দামুড়হুদা থানা পুলিশ গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্মআহ্বায়ক মাসুদ রানা (৩০) ও শিবির সমর্থক হাসান আলী নামে দুজনকে গ্রেফতার করেছে। ছাত্রদল নেতা মাসুদ রানা উপজেলার কুড়ুলগাছি গ্রামের মৃত মতলেব মণ্ডলের ছেলে এবং হাসান রুদ্রনগর গ্রামের ফজলুল হকের ছেলে।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছেন, নাশকতার আশঙ্কায় জামায়াত-বিএনপির ১৩ জন কর্মী সমর্থককে আটক করেছে মেহেরপুর পুলিশ। মেহেরপুর সদর থানা ৪ জন, গাংনী থানা ৬ জন ও মুজিবনগর থানা পুলিশ ৩ জনকে আটক করে। আটককৃতরা হলেন- জেলা শহরের বাসস্ট্যান্ডপাড়া এলাকার জমির উদ্দীনের ছেলে মিন্টু হোসেন (২৭), সদর উপজেলার হরিরামপুর গ্রামের মনিরুল ইসলামের ছেলে বিনারুল ইসলাম (২৬), একই গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে আহসান হাবীব (২৬), রুদ্রনগর গ্রামের মৃত পাতান শেখের ছেলে মুক্তি হোসেন (২৮), মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান গ্রামের ছইমদ্দীনের ছেলে সাজেদুল হক (২৭), একরামুল হকের ছেলে সবিরুল ইসলাম (৩০) ও সুলতান হকের ছেলে আবুল হাশেম (৪৫), গাংনী উপজেলার মহিষাখোলা গ্রামের রইছদ্দীনের ছেলে খোকন (৪০), পুরাতন মটমুড়া গ্রামের মৃত ওয়াজের আলীর ছেলে মতিয়ার রহমান (৪০), কুষ্টিয়ার জেলার খাজানগর এলাকার ইউনুস আলীর ছেলে তরিকুল ইসলাম ওরফে রানা (২৩), কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার বানিয়া শিশা গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে সুমন হোসেন (২৫), কুষ্টিয়া জেলা শহরের আড়ুয়াপাড়া এলাকার শুকুর দত্তের ছেলে মোমিন দত্ত (২২) ও একই এলাকার শোভাষের ছেলে শৌরভ (২৪)।

বামন্দী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই তোহিদুল ইসলাম বামুন্দী বাজার এলাকা থেকে তরিকুল ইসলাম ওরফে রানা, সুমন হোসেন, মোমিন দত্ত ও শৌরভকে আটক করেন। এদের মধ্যে একজন জন জামাত অন্যরা বিএনপি কর্মী বলে জানিয়েছেন গাংনী থানার ওসি রিয়াজুল ইসলাম। এলাকায় নাশকতা ঘটাতে তারা কুষ্টিয়া থেকে গাংনীর বামন্দী এলাকায় জড়ো হয়েছিলো বলে প্রাথমিক ধারণা করছে পুলিশ। তবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

গাংনী থানার ওসি রিয়াজুল ইসলাম, সদর থানার ওসি আহসান হাবীব ও মুজিবরনগর থানার ওসি রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একাধিক টিম বুধবার দিবাগত রাতভর জেলার বিভিন্ন গ্রামে এসব ব্যক্তির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করেন।

পুলিশ সুপার হামিদুল আলম জানান, ২০ দলের ডাকা চলমান অবরোধের সময় এলাকায় নাশকতার আশঙ্কায় তাদের আটক করা হয়েছে। কার্যবিধির ১৫১ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে মেহেরপুর জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। এদিকে বিএনপি নেতা কর্মীদের বিনা মামলায় আটক, নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহত্রাণবিষয়ক সম্পাদক সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মাসুদ অরুন।