বাসে পেট্রোল বোমা : দগ্ধ ১৯ :হাসপাতালে ১ জনের মৃত্যু : আশঙ্কাজনক ৩ জন

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির তৃতীয় দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হঠাত শাহবাগে একটি বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে আগুন দেয়া হয়। মুহূর্তের মধ্যে প্রায় শান্ত রাজধানী হয়ে পড়ে অচেনা। ছোটাছুটি, আত্মচিত্কার আর আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে রাজধানীর শাহবাগের পরিবেশ। দুর্বৃত্তদের দেয়া সেই সহিংসতার আগুনে সাংবাদিক, আইনজীবী, পুলিশ ও নারী-শিশুসহ অন্তত ১৯ জন পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে রাতে হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আরো তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিত্সকরা জানিয়েছেন।

5297230f0f47b-1

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাস-পাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিত্সাধীন অবস্থায় অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে নাহিদ মোড়ল (১৭) মারা যায়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় বার্ণ ইউনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। নিহত নাহিদ মোড়ল মাদারীপুরে শিবচরের হাজি আইজউদ্দিন মোড়ল কান্দি গ্রামের সোহরাওয়ার্দী মোড়লের ছেলে। সে কুতুবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম
শ্রেণির ছাত্র। ঢাকার সাভারে তার মামাতো ভাই রবিনের বাসায় গিয়েছিলো। বৃহস্পতিবার দুপুরে রবিনকে সাথে নিয়ে একটি জ্যাকেট কেনার জন্য গুলিস্তানে যায়। জ্যাকেট কেনা না হলে তারা ফার্মগেটে তাদের আরেক মামাতো ভাই আক্তারের সাথে দেখা করার জন্য বিহঙ্গ পরিবহনের ওই বাসে রওনা দেয়।

এর আগে ভোর থেকেই বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল, বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়। এতে পুলিশ ও পথচারীসহ আহত হয় বেশ কয়েকজন। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে নগরীর বিভিন্নস্থানে ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। সকালে থেকে যান চলাচল কম থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে যাত্রী পরিবহনের সংখ্যা কিছুটা বেড়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিহঙ্গ পরিবহনের বাসটি গুলিস্তান থেকে মিরপুরের দিকে যাচ্ছিলো। মত্স্যভবন থেকে যাত্রী নামিয়ে শাহবাগ মোড়ে যাওয়ার আগেই শিশুপার্কের কাছে কয়েক যুবক পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারে। গেটের কাছেই সেটি বিস্ফোরিত হয়ে গাড়ির ভেতরে আগুন ধরে যায়। এ অবস্থায় চালক গাড়ি চালিয়ে সামনে এগুনোর চেষ্টা করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক বিভাজনের সাথে ধাক্কা খায়। এ সময় দ্রুত বাস থেকে নামতে গিয়ে ১৯ জন অগ্নিদগ্ধ হন। আহতরা হলেন- একুশে টেলিভিশনের মুক্ত খবর অনুষ্ঠানের খুদে সাংবাদিক সুস্মিতা সেন, তার মা গীতা সেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হাবিলদার নূরুল ইসলাম, আইনজীবী খোদেজা বেগম, গাড়ি চালক মাহবুব এবং যাত্রী জাহাঙ্গীর আলম, শফিকুল ইসলাম, মাসুদ, বাবু, আমজাদ, রাহাদুল, নাহিদুল, রিয়াদ, আবু তালেব, রবিন ও আবদুর রাজ্জাক। অন্যদের পরিচয় তাত্ক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

আহত কয়েকজন যাত্রী জানান, বাসে আনুমানিক ৩০ জন যাত্রী ছিলো। প্রেসক্লাবের সামনে থেকে দু-তিন জন যুবক বাসে ওঠে। তাদের হাতে প্লাস্টিকের বোতল ও একটি পুঁটলা ছিলো। বাসটি শিশুপার্কের সামনে পৌছানো মাত্র বিকট একটি শব্দে গেটের কাছে বিস্ফোরণ ঘটে। এক যুবক বাসের মধ্যে তখন পেট্রোল ঢেলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এতেই আগুন ধরে যায়। তবে বাস হেলপার রফিকুল ইসলাম জানান, চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় গেটের কাছে বিস্ফোরণের পর দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। প্রথমে চালক মাহবুব টের পাননি। পরে চিত্কার শুনে বাস থামিয়ে ফেলেন তিনি। তার অবস্থাও বেশি ভালো না বলে জানান হেলপার।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন মাসুদ জানান, শিশুপার্কের সামনে তারা হঠাত করেই বাসের সামনে আগুন দেখতে পান। সেই আগুন ক্রমশ ভেতরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার লাইটপোস্ট ভেঙে সড়ক বিভাজকের ওপর উঠে যায়। অন্য যাত্রী রাহাদুল জানান, জানালার পাশের সিটে বসা ছিলাম। হঠাত আগুন দেখে চিত্কার দিয়ে উঠি। কুলকিনারা না পেয়ে জানালার গ্লাস ভেঙে নিচে লাফ দেই। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, রাজনীতিবিদরা তো ভালোই থাকেন। তারা ক্ষমতার জন্য লড়াই করছেন। আর সাধারণ মানুষ আগুন ও গুলি খেয়ে মরছে।

রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শিবলী নোমান জানান, এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা যা খুবই নিষ্ঠুর। এর সাথে ইন্ধনদাতা, মদদদাতা কারা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারা হলে বাসটিতে আগুন ধরে যায়।

বাসে লেগুনায় আগুন ভাচুর: এর আগে বাসে আগুন, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াসহ নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে গতকাল অবরোধের শেষ দিন পার করলো বিএনপি-জামায়াত। উত্তরায় বাসে আগুন, আজিমপুরে পুলিশ-অবরোধকারীর মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও পল্টনে পুলিশের ওপর হামলা করেছে অবরোধকারীরা। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গাবতলী ও মহাখালী বাসটার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। রাজধানীতে ১৮জন আটক হয়েছে। এরমধ্যে তিনজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অবরোধের প্রথম দু দিনের চেয়ে গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে যানবাহন চলাচল বেশি ছিলো। সকালে ধানমন্ডির ১৫ নম্বরে জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা যাত্রীবাহী লেগুনায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় এবং মোহাম্মদপুর-মতিঝিল সড়কপথের মৈত্রী পরিবহনের একটি গাড়িতে পেট্রলবোমা ছুঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

মিরপুর, ধানমন্ডি, গুলশান-বনানীসহ আশপাশের এলাকায়ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এ সময় পুলিশের সাথে অবরোধকারীদের কয়েকদফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শিবিরকর্মীরা ভোরে মিরপুরের শাহআলী রোডে একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। দুপুর ১২টার দিকে নিউমার্কেট এলাকায় একটি বাসে আগুন দেয় অবরোধকারীরা।