বাতিল হচ্ছে না কোনো পরীক্ষা : প্রশ্নফাঁসের দায়মুক্তি চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়!

স্টাফ রিপোর্টার: প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ মিললে পরীক্ষা বাতিল করা হবে বলে খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘোষণার পর এ সংক্রান্ত মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হলেও বাস্তবে এর পুরোটাই লোক দেখানো একটি প্রক্রিয়া মাত্র। কার্যত কোনো পরীক্ষা বাতিল করার সামান্য ইচ্ছাও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নেই। বরং এর মাধ্যমে তারা তাদের ঘাড়ে চেপে বসা প্রশ্নফাঁসের দায় এড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি এসব প্রশ্নফাঁস হওয়ায় পরীক্ষার্থীদের ততোটা ক্ষতি হয়নি, মূল্যায়ন কমিটির কাছ থেকে এ সংক্রান্ত বক্তব্য সংগ্রহ করাই এর মূল লক্ষ্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ কারণে ফাঁসকৃত প্রশ্নের পরীক্ষা বাতিল করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে দেশের চলমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এ সময় সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় মেনে নিলে বিরোধী দলগুলো এ ইস্যুতে আন্দোলন চাঙ্গা করার পাশাপাশি নানামুখি সমালোচনার সুযোগ পাবে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্নীতি ও ব্যর্থতার চিত্র জনসম্মুখে উন্মোচিত হবে। যা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে।

অন্যদিকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কারণে তা বাতিল করে পুনঃপরীক্ষা নেয়া হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের ফুঁসে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি তাদের সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষও যোগ দিতে পারে।

তৃতীয়ত, পুনঃপরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধেও সরকার কতোটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ অবস্থায় তারা ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠবে। চতুর্থতো, এখন পর্যন্ত সরকার প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের মূল হোতাদের কারও টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। এমনকি তারা কোন কৌশলে, কোথা থেকে কীভাবে প্রশ্নফাঁস করছে তাও গোয়েন্দাদের এখনও অজানা। এছাড়া প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে এ চক্রের গডফাদারদের সম্পর্কে কোনো ক্লু পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। তাই প্রশ্নফাঁস রোধে গোয়েন্দারাও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।

অন্যদিকে পুনঃপরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি এবং খাতা দেখা শেষে ফল প্রকাশ করার মতো পর্যাপ্ত সময়ও এখন শিক্ষকদের হাতে নেই। কেননা এরই মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষা আগামী ২ এপ্রিল থেকে শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পুনঃপরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করা হলে হ-য-ব-র-ল দশা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ছাড়া নতুন করে আরও কোনো সংকট তৈরি হতে পারে বলেও সরকার আশঙ্কা করছে। তাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কিছুটা সমালোচনা গায়ে মেখেই ঝুঁকি এড়াতে চাইছে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া পরীক্ষা বাতিল না করার ব্যাপারে এরই মধ্যে তারা গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছে। এখন এ ব্যাপারে দায়মুক্তির সনদ তৈরির পথ খোঁজা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, প্রশ্নফাঁস হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ না থাকায় তা মেনে নিয়েই মূল্যায়ন কমিটি প্রতিবেদন তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও তা পরীক্ষা শুরুর মাত্র ১৫/২০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের হাতে পাওয়ায় তা থেকে তারা বিশেষভাবে উপকৃত হয়নি, এ বিষয়টিতে গুরম্নত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ফাঁসকৃত প্রশ্ন পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার হলেও মোট পরীক্ষার্থী ২০ লাখেরও বেশি, তাই পুনঃপরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই, এমন সুপারিশ করার কথাও ভাবছে মূল্যায়ন কমিটি।

যদিও সংশ্লিষ্টদের কেউ এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। কমিটির সদস্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘আমরা কাজ শুরু করেছি। এর বেশি কিছু বলা যাবে না। তদন্ত কাজ শেষ হলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

মূল্যায়ন কমিটির প্রধান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্য এসেছে আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করবো। প্রতিটি পরীক্ষাকে আমরা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করব। কোনো পরীক্ষার প্রশ্ন আসলে ফাঁস হয়েছে আর কোনগুলো ফাঁস হয়নি সেসব বিষয়ে আমাদের আলাদা মূল্যায়ন থাকবে। কোনো পরীক্ষা বাতিল হবে কিনা সে বিষয়ে আমরা সুপারিশ করব। তবে সেটা বাস্তবায়ন করবে মন্ত্রণালয়।’

তবে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জানান, পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত আপাতত তাদের নেই। কারণ এতে তারা বড় কোনো লাভ দেখছেন না। এছাড়া বেশ ক’জন প্রশ্নফাঁসকারী ধরা পড়ছে। অচিরেই এদের পুরো সিন্ডিকেট ধরা যাবে। তাই পুনঃপরীক্ষা নেয়া ততোটা জরুরি নয়- অভিমত প্রতিমন্ত্রীর।

এদিকে পরীক্ষা শুরুর এক সপ্তাহ আগে সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির এক বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই পরীক্ষা বাতিলের জোরাল হুঁশিয়ারি জানালেও এ ব্যাপারে তিনি এখন কিছু বলছেন না। এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসেনের সুরও এখন অনেকটাই নরম।

শিক্ষাবিদরা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন মূল্যায়ন কমিটি ও পুনঃপরীক্ষার ব্যাপারে কোনো ধরনের কথা না বলে প্রশ্নফাঁস রোধে নানা পরিকল্পনার ছক প্রকাশ করছেন। শিক্ষাবিদদের ভাষ্য, অতীতেও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর সে ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নতুন করে নানা ছক আঁটা হয়েছে। এবারও তা-ই হচ্ছে। এতে মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন কী হবে তা অনেকটাই বোঝা গেছে- যোগ করেন শিক্ষাবিদরা।

এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে-বিপক্ষে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের ভিন্নমত পাওয়া গেছে। খুবই সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছেন।

চলমান পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা করে শিক্ষাবিদদের অনেকে বলেন, এমনিতেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। এর ওপর প্রশ্নফাঁস রোধে শিক্ষা প্রশাসনের ব্যর্থতার খড়গ যেভাবে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা চলছে তাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে গভীর শঙ্কা রয়েছে।

তাদের ভাষ্য, প্রশ্নফাঁস হয়েছে তা প্রমাণিত হলে পরীক্ষা বাতিল করা হলে তা ‘উদোর পিণ্ডি বুঁদোর ঘাড়ে’ চাপানোর নামান্তর। কেননা পরীক্ষার্থীরা মেধা-ঘাম ঝরিয়ে যে পরীক্ষা দিয়েছে তা বাতিল হলে শিক্ষার্থীদের ফের একই কষ্ট করতে হবে। পুনঃপরীক্ষায় এক প্রশ্ন দ্বিতীয়বার আসার সম্ভাবনা কম থাকায় পরীক্ষার্থীরা নতুন করে ‘কমন প্রশ্ন’ খুঁজবে। এতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী নিয়ম অনুযায়ী পড়াশোনায় খেই হারাবে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।

এদিকে এ ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-টুইটারে সমালোচনার তীব্র ঝড় বইছে। ‘আমি সেই নয়ন’ নামের একটি আইডিতে আপলোডকৃত পোস্টেবলা হয়েছে প্রশ্নফাঁস প্রশ্নফাঁস। ‘আজকাল প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। এবার এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। আর শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, যদি প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সারাদেশের পরীক্ষা বাতিল করে আবার পরীক্ষা নেয়া হবে। যদি আবার পরীক্ষা নেয়া হয় আর তখনও যদি প্রশ্নফাঁস হয় তাহলে কি আবার পরীক্ষা নেয়া হবে? আমার মনে হয় না প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে পারবে।’

‘আমার মনে হয় প্রশ্নফাঁস তো আর সাধারণ জনগণ করছে না। এর সঙ্গে জড়িত ওপর মহলের কিছু অসাধু লোক। আর প্রশ্ন তো সবাই পায় না, পায় কিছু প্রভাবশালী, বড় লোকদের ছেলে-মেয়েরা। যদি টাকা দিয়ে প্রশ্ন কেনা যায় তাহলে পরীক্ষা নেয়ার দরকার কী? আর এ প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারে সরকার এতো উদাসীন হয় কীভাবে। প্রশ্নফাঁস করে পরীক্ষা দেয়ারও তো কোনো মানে নেই।’

অন্য একটি আইডি থেকে দেয়া পোস্টে বলা হয়েছে- ‘প্রশ্নফাঁস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরও যখন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা বলেন, প্রশ্নফাঁস হয়নি…কিছুই হয়নি, এমন ভাব করে তখন প্রশ্নফাঁসকারীরা আরও উৎসাহিত হয়। এসব কাণ্ড জ্ঞানহীন লোককে দিয়ে কখনও শিক্ষার উন্নতি করা সম্ভব নয়।’