বাজেট আলোচনায় এমপিদের বিরোধিতা

 

স্টাফ রিপোর্টার: বাজেট নিয়ে ক্ষোভ জানাচ্ছেন এমপিরা। প্রকাশ করছেন অসন্তোষ। তুলে ধরছেন নির্বাচনী এলাকার তৃণমূল মানুষদের কথা। বিশেষ করে, আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও ভ্যাট নিয়ে এমপিদের ক্ষোভ বেশি। তাদের বক্তব্য, এবারের বাজেট সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ সামনে নির্বাচন। অর্থমন্ত্রী ভোট বান্ধব বাজেট না দিয়ে উল্টো কিছুটা জনবিরোধী বাজেট দিয়েছেন। এমপিদের আশঙ্কা, এতে সরকারের সব অর্জন ম্লান হতে পারে। উল্টে যেতে পারে ভোটের হিসাব-নিকাশ। সাধারণত সংসদের বিরোধী দল বাজেট নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে, সমালোচনা করে। এবার চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সরকারি দলের এমপিরাও বাজেটের কঠোর সমালোচনায় মুখর। দিন দিন তাদের সমালোচনার ভাষা আরো কঠোর হচ্ছে। ওদিকে, এরই মধ্যে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমার্জন ও সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে। এ ধরনের দাবি গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই প্রথম। গত এক সপ্তাহে বাজেট নিয়ে সংসদে এমপিদের আলোচনা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ১লা জুন সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। ঐক্যমত্যের সরকারের চতুর্থ ও দেশের ৪৬তম বাজেট এটা। সংসদ কার্য-উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪৫ ঘণ্টা আলোচনার পর আগামী ২৯ জুন প্রস্তাবিত বাজেট পাস হবে। সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, সাধারণত বাজেটের পক্ষে সাফাই বক্তব্য দেন সরকারি দলের এমপিরা। আর বিরোধিতা করেন বিরোধী দলের এমপিরা। এবার দুই পক্ষই বাজেট নিয়ে অভিন্ন বিষয়ের ওপর সমানতালে ক্ষোভ জানাচ্ছেন। সংসদীয় ইতিহাসে এ ধরনের উদাহরণ খুব কমই আছে। এদিকে বাজেটের সমালোচনার পাশাপাশি এমপিরা ক্ষোভ জানাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওপরও। এটা তার জীবনের একাদশতম বাজেট। গত ৭ই জুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাজেট আলোচনায় বলেন, আমি কেবিনেটের সদস্য। কেবিনেটে এই বাজেট পাস হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কথা বলা নৈতিকতা বিরোধী। তবে আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। তাদের কথা বলতে হবে। তিনি বলেন, সঞ্চয় এবং ফিক্সড ডিপোজিটের ওপর কর আরোপ করা ঠিক হবে না। সাধারণ মানুষ, স্বল্প বেতন পাওয়া মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। ১৫ই জুন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাবকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ব্যাংকে আমানতের সুদ নিম্ন পর্যায়ে। এ ছাড়া রয়েছে মূল্যস্ফীতি, সুদের ওপর কর এবং ব্যাংকের সেবা মাশুল (সার্ভিস চার্জ)। তারপরও ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক আরোপ হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাড়তি আবগারি শুল্ক থেকে সরকার কত পাবে? আয় আসবে ২০০ কোটি টাকার মতো। এজন্য বিপুল লোকের আয় কমিয়ে দেব? তিনি প্রশ্ন রাখেন, অর্থমন্ত্রী কি আমাদের যক্ষের ধনের পাহারাদার বানাচ্ছেন? পুরো প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলে ক্ষতি হবে বড়জোর ৩৫৫ কোটি টাকা। এটা বাজেটের খুবই ক্ষুদ্র অংশ। সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোও ঠিক হবে না বলে মনে করেন কৃষিমন্ত্রী।

মন্ত্রী বলেন, আমরা অনেক শ্রেণির মানুষকে ভর্তুকি দিই, যারা প্রাপ্য নন। তার চেয়ে বড় কথা, ঋণখেলাপিদের বিশাল বোঝা নিয়ে তোয়াজ করতে পারি, তাহলে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের সামান্য বোঝা নেব না কেন? আলোচনায় অংশ নিয়ে বগুড়া থেকে নির্বাচিত আবদুল মান্নান বলেন, অর্থমন্ত্রী সিলেটে বলেছেন, আবগারি শুল্ক প্রত্যহারের কোনো পরিকল্পনা নেই। আমি বলি এখানে জেদ ধরার কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগ মানুষের জন্য কাজ করে। ভোটের রাজনীতি করে। তাই জনগনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, নির্বাচনের আগে যদি বাজেটে এ দুই বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন, আমাদের সম্পর্কেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। অর্থমন্ত্রী প্রতিবছরের বাজেট বক্তব্যে যে একটা করে শিরোনাম দেন, তা দেখে দেশের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা দেখতে পান না বলে জানান তিনি।

এদিকে এবারের বাজেটে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে বলে দাবি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। তাই প্রস্তাবিত বাজেট পুনর্বিবেচনা ও পরিমার্জনের দাবি তুলেছে তারা। জাতীয় পার্টির অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, অর্থমন্ত্রী দেশের সকল নাগরিকের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। আজ যে শিশুটি জন্ম নিলো তার মাথায়ও ঋণের বোঝা রয়েছে। এই বাজেটে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ খুশি হতে পারেনি বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে। আবগারি শুল্কের কারণে মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। অনেক কিছু করার পরও ভ্যাট আর আবগারি শুল্কের কারণে জনমনে বিরক্তি তৈরি হয়েছে। সিলেট-২ আসনের জাতীয় পার্টি দলীয় এমপি ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, বাজেট বড় হলেই কৃতিত্বের কিছু নেই। বাজেটকে বাস্তবায়ন করতে হবে। এবারের বাজেটে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। তাই এবারের বাজেট পুনর্বিবেচনা করা হোক। পরিমার্জন করা হোক। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম বলেন, বেশির ভাগ মানুষ এই বাজেটে খুশি হতে পারেনি। আবগারি শুল্ক আর ১৫ ভাগ হারে ভ্যাট বাড়ানোর ইস্যুতে চাপা পড়ে গেছে বাজেটের আরও অনেক দিক। অতিরিক্ত ভ্যাটের কারণে অনেক কোম্পানি ও কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। তিনি বলেন, এবারের বাজেটের অন্যতম দিক হলো অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর।

আবগারি শুল্ক নিয়ে প্যানিক তৈরি হয়েছে। জনগণের সঞ্চয়ের ওপরও অর্থমন্ত্রীর নজর পড়েছে। দুর্নীতি সহায়ক, অবিবেচক এবং অতিরিক্ত কর আরোপের পথ থেকে অর্থমন্ত্রীকে সরে আসার আহ্বান জানান তিনি। ওদিকে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাসদের বেগম শিরিন আখতার বলেন, ১৪ দল আর সরকার একসাথে দুটি যুদ্ধ করছে। একটি সংবিধান সম্মত রাখার যুদ্ধ আরেকটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যুদ্ধ। জাসদ বারবারই প্রগতিশীল কর নীতির কথা বলেছে। এবারের বাজেটে গরিবদের জন্য আরও সহনীয় করা যেতে পারে। জাসদ আশা করে বাজেটের পরিমার্জন করা হবে।