বাংলাদেশকে না জানিয়ে সীমান্তে গুলি নয়

বিজিপির সাথে পতাকা বৈঠকে বিজিবির বার্তা

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশকে না জানিয়ে সীমান্তে ফাঁকা গুলি ছোড়ার বিষয়ে মিয়ানমারকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সীমান্তে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড কমিয়ে উত্তেজনা প্রশমন করারও আহ্বান জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তে দু’দেশের সীমান্তরক্ষীর মধ্যে পতাকা বৈঠকে এ অগ্রগতি হয়। এদিকে সীমান্তের ওপারে কাঁটাতারের বেড়া ঘেঁষেই কয়েকদিন ধরে অবস্থান করা মিয়ানমারের সেনা ও বিজিপি সদস্যরা গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে কিছুটা পিছু হটেছে। অন্যদিকে সীমান্তে নতুন করে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নতুন করে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রায় ২০০ সেনা মোতায়েন করে মিয়ানমার। এ ঘটনায় বাংলাদেশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লুইন উ’কে তলব করে তাকে একটি নোট ভারবাল বা আনুষ্ঠানিক পত্র দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিজিবি-বিজিপি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে ৭ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান। আর মিয়ানমারের পক্ষে সাত ৭ সদস্যের নেতৃত্ব দেন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার সুচায়ে হু। এর আগে বৈঠকে অংশ নিতে ঘুমধুম বিজিবি ক্যাম্প থেকে পায়ে হেঁটে বিজিবি’র সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সংযোগ সড়কের মৈত্রী লালব্রিজ এলাকায় যায়। অপর প্রান্ত থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীর প্রতিনিধি দলটিও পায়ে হেঁটে দু’দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছায়।

বৈঠক শেষে ফিরে বিজিবি ৩৪ ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার লে.কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান সাংবাদিকদের বলেন, শূন্যরেখায় (নো ম্যানস ল্যান্ডে) আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আবারো আশ্বস্ত করেছে মিয়ানমার। তবে সীমান্তে জিরোলাইনে ফাঁকা গুলি ছোড়ার ঘটনাটি অস্বীকার করেছে তারা। বিজিবির পক্ষ থেকে সীমান্তে ফাঁকা গুলি ছোড়ার বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো হয় এবং আগামীতে ফাঁকা গুলি ছোড়ার আগে বিজিবিকে অবহিত করতে বলা হয়েছে। মিয়ানমার বিষয়টিতে একমত হয়েছেন। বৈঠকে মিয়ানমার দাবি করেছে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত এলাকায় প্রায় সময়ই সেনা-বিজিপি মোতায়েন করা হয়। বাড়ানো হয় ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টহলও। এটি সম্পূর্ণ মিয়ানমারের নিজস্ব বিষয়। ফাঁকা গুলিও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ছোড়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকেও একই দাবি করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের একজন মুখপাত্র জ হতয় বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন করে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিরোধিতা করার লক্ষ্যে সেনা সমাবেশ নয়। এটা সম্পূর্ণ নিরাপত্তার স্বার্থে।

এদিকে তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা সমাবেশ বাড়ানোয় নো ম্যানস ল্যান্ডের প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা  আতঙ্কে রয়েছেন। গতকাল সকালেও দুটি পিকআপ ভ্যানে করে নো ম্যানস ল্যান্ডের কোনাপাড়া আশ্রয় ক্যাম্পের ওপারে তুমব্রু সীমান্তে সেনা সংখ্যা বাড়িয়েছে মিয়ানমার। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশও সীমান্তে টহল জোরদার করেছে। বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর থেকে কাঁটাতারের ওপারে মিয়ানমারের সেনা-বিজিপির অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান এবং টহলের দৃশ্য দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। যদিও তারা কাঁটাতারের বেড়া থেকে পিছু হটেছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সরওয়ার কামাল জানান, সীমান্তের ওপারে কাঁটাতারের বেড়া ঘেষেই কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের সেনা ও বিজিপি সদস্যরা অবস্থান করছিলো। কিন্তু শুক্রবার সকাল থেকে মিয়ানমারের সেনারা কাঁটাতারের বেড়া থেকে কিছুটা পিছু হটেছে।

শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া কোনাপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা নূর হোসেন বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতের বেলায় কয়েক দফায় মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের নো ম্যানস ল্যান্ড ছাড়তে বলেছে মিয়ানমারের বিজিপি। মদের বোতল ছুড়ে মেরেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেনি রোহিঙ্গারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, সীমান্ত সুরক্ষায় বিজিবি সতর্ক প্রহড়ায় রয়েছে। বাড়ানো হয়েছে সীমান্ত এলাকায় বিজিবির জনবল এবং শক্তিও।

সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়েই মূলত উত্তেজনা। শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয়া প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অংশেই নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান করছে। মিয়ানমারের সেনা-বিজিপি ভয়ভীতি সৃষ্টি করে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু বিজিবি-প্রশাসনের কঠোর নিরাপত্তায় সম্ভব হচ্ছে না।

সেনা সমাবেশে উদ্বেগ উত্কণ্ঠায় থাকা তুমব্রু সীমান্তবাসীর সাথে গতকাল দুপুরে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদে বৈঠক করেছে প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে তুমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বলেন, সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে কোনো সমস্যা নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান করায় উদ্বেগ উত্কণ্ঠা রয়েছে সীমান্তবাসীর মধ্যে। তাদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করে বলেছি উদ্বেগ উত্কণ্ঠার কোনো কারণ নেই। সার্বিক পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।