বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের ১৭টি বিদ্যুত কেন্দ্র

 

চারটি কেন্দ্র চলতি বছরের জুনেই বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি

স্টাফ রিপোর্টার: দেশের ১৭টি বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে চারটি কেন্দ্র চলতি বছরের জুনেই বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আটটি বন্ধের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুইটি কেন্দ্রের জীবনসীমা শেষ হওয়ার আগেই বন্ধ করার পরিকল্পনা আছে। আর ২০১৮ সালে একটি এবং ২০১৯ সালে আরেকটি কেন্দ্র বন্ধ করা হতে পারে।

পিডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত ৪৫ বছরে একবারও দেশে বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর প্রকৌশল দক্ষতা নিরুপণে জ্বালানি নিরীক্ষা হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রতি দুই বছরে অন্তত একবার জ্বালানি নিরীক্ষা হয়। নিরীক্ষা না হওয়ায় সময়মতো কেন্দ্রগুলোর পুনর্বাসন, আধুনিকায়ন, মেরামত বা সংস্কার করা যায়নি। তাই অনেক কেন্দ্রের দক্ষতা কমেছে ও জ্বালানি খরচ বেড়ে গেছে। জীবনসীমা সমাপ্ত, দক্ষতা হ্রাস ও গ্যাস সংকটের কারণে ওই বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

পিডিবির মালিকানাধীন এই বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১০টিই গ্যাসচালিত কেন্দ্র। এগুলোর উত্পাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৮৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুত। কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হলে এই পরিমাণ বিদ্যুত উত্পাদনও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি পূরণ করতে সরকারকে হিমশিম খেতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত ১০ মে এক চিঠিতে পিডিবি জানায়, পুরনো বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে অবসর প্রদান ও নতুন বিদ্যুত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সম্মতি প্রয়োজন। সেই সম্মতি পাওয়া গেলে প্রকল্পগুলোর জন্য পৃথকভাবে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাই ও অর্থায়নের উত্স নির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, পিডিবির প্রস্তাব পেয়েছি। কেন্দ্রগুলো একবারে বন্ধ না করে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হবে। কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে সেখানে নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

পিডিবির এক সদস্য বলেন, পুরনো  কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অনেকগুলোরই উত্পাদন ক্ষমতা এতো কমে গেছে যে সেগুলো সংস্কার করলেও তেমন সুফল পাওয়া যাবে না। নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন কিংবা বিকল্প উপায়ে বিদ্যুত উত্পাদন বাড়িয়ে ধীরে ধীরে এগুলো বন্ধ করা হবে। এর ফলে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি হবে না।

সম্প্রতি দেশের পুরনো বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর কারিগরি নিরীক্ষার জন্য ভারতের স্টিগ অ্যানার্জি সার্ভিসেসকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় পাউয়ার সেল। স্টিগের নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিষয়ে মতামত দেয়ার জন্য গত এপ্রিলে পিডিবিকে অনুরোধ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মে এক চিঠিতে পিডিবি জানায়, পিডিবির বিদ্যমান পুরাতন বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোর বর্তমান অবস্থা-দক্ষতা বিবেচনা করে কেন্দ্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, পুনর্বাসন, মেশিনের দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা অবসর দেয়া অথবা ভেঙে ফেলে নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ১৭টি বিদ্যুতকেন্দ্রকে অবসর দেয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে। পিডিবির সাধারণ বোর্ড সভায় ওই কমিটির প্রতিবেদন অনুমোদিত হয়। বন্ধের জন্য সুপারিশকৃত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ভেড়ামারা ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র, রংপুর ২০ মেগাওয়াট, বরিশাল ৪০ মেগাওয়াট ও সৈয়দপুর ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র ২০১৬ সালের জুনে বন্ধ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই চারটিই ডিজেলচালিত। বন্ধ হতে যাওয়া গ্যাসচালিত ১০টি কেন্দ্র হলো- কুমারগাঁও ২০ মেগাওয়াট, টঙ্গী ১০৫ মেগাওয়াট, শাহজীবাজার ৭০ মেগাওয়াট, শিকলবাহা ৬০ মেগাওয়াট, রাউজান ৪২০ মেগাওয়াট, ফেঞ্চুগঞ্জ ৯৭ মেগাওয়াট, হরিপুর ৬০ মেগাওয়াট, সিদ্ধিরগঞ্জ ২১০ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ী ১০০ মেগাওয়াট ও ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র। এর মধ্যে রাউজান ও ফেঞ্চুগঞ্জ কেন্দ্র দুইটির জীবনসীমা যথাক্রমে ২০২৬ ও ২০২২ সাল হলেও এগুলো ২০২০ ও ২০১৮ সালে বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। গ্যাস স্বল্পতাকেই এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বড়পুকুরিয়া ২৫০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রটিও বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। বন্ধের সুপারিশকৃত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বিদ্যুতকেন্দ্র ১৯৭৩ সালে নির্মিত। ফার্নেস তেলে চালিত খুলনার ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ তাপ বিদ্যুেকন্দ্রটি ২০১৪ সাল হতে অবসর প্রদানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। খুলনার ১১০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র চলতি বছর বন্ধ করা হয়েছে।

এদিকে স্টিগের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সারমর্ম বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। সময়মতো ওভারহোলিং (ভালো করে সারানো) না করায় অনেক কেন্দ্রের উত্পাদন ক্ষমতা কমে গেছে।  আবার অর্থনৈতিক বয়স পেরিয়ে গেলেও অনেক কেন্দ্র প্রতিস্থাপন করা হয়নি। ফলে জ্বালানি খরচ বেড়ে গেছে। কেন্দ্রগুলোর দক্ষতা বর্তমানে মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এসব কেন্দ্রে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ পড়ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোতে সময়মতো কারিগরি নিরীক্ষা না করার মাশুল সকলকেই দিতে হচ্ছে। কেন্দ্রগুলো বন্ধের পাশাপাশি বিদ্যুতের বড় প্রকল্পগুলো চালু করা না গেলে বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।