বছরের শুরুতে আবারও বেপরোয়া লাইব্রেরি মালিকরা : মলাটে নাম বদলে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ নোট : গাইড বই

ফাইজার চৌধুরী: প্রতিবছরের মতো এবারও চুয়াডাঙ্গা জেলার ৪টি উপজেলার লাইব্রেরিগুলোতে প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারছে বিক্রি হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই। তবে কৌশল অবলম্বন করে পাল্টে ফেলা হয়েছে নাম ও মলাট। নোটবই বিক্রি হচ্ছে সহায়িকা অথবা একের মধ্যে এক, দুই, পাঁচ থেকে সব- এ ধরনের বাহারি নামে।

ফলে একদিকে মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে নিষিদ্ধ বাহানায় ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের নিকট বেশি দামে এসব গাইড বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন অসাধু লাইব্রেরির মালিকগণ। একইভাবে চলছে ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যকরণের ব্যবসা।

দৈনিক মাথাভাঙ্গার অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া গেছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সরকারি- বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা বই কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিম্নমানের গ্রামার বইয়ের নাম প্রেসক্রাইব করছেন। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বাসিন্দা কোরবান আলী। গতকাল শনিবার একটি লাইব্রেরিতে এসেছিলেন গ্রামার ও গাইড বই কিনতে। কথা হলো তার সাথে। তিনি জানালেন, তার সন্তান সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, সরকার আমার সন্তানের সব বই বিনামূল্যে দিলো, আর স্কুলের স্যারদের কথা অনুযায়ী আমাকে ৩টি বই কিনতে ৯৩০ টাকা লাগলো। কি-বা করার আছে? আমরা তো জিম্মি!

প্রতিবছর নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে চুয়াডাঙ্গায় প্রশাসনের উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বিক্রি নিষিদ্ধ নোট-গাইড জব্দ করা হয়। দু’একবার লাইব্রেরি মালিক গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে। প্রশাসনের শক্ত অবস্থান আর একের পর এক অভিযানের কারণে ইতঃপূর্বে লাইব্রেরিতে বিক্রির জন্য মজুদ করা নোট, গাইড উদ্ধার হয়েছে ল্যাট্রিনের সেফটি ট্যাংক থেকে। আর এবার? অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন নীরব আর এ নীরবতাকে সন্দেহের চোখে দেখছে অভিভাবকমহল।

এ চিত্র শুধু চুয়াডাঙ্গার নয়, পাশের জেলা মেহেরপুরেও। চলতি বছর মেহেরপুর জেলায় মাত্র একবার অভিযান চালিয়েছে মেহেরপুর প্রশাসন তাও আবার গাংনী উপজেলায়। নোট-গাইডবিরোধী ওই অভিযানে এক লাইব্রেরি মালিককে দু হাজার টাকা জরিমানা ও একটি বইয়ের গোডাউন সিলগালা করে দেয়।

সরেজমিনে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চুয়াডাঙ্গার লাইব্রেরি মালিকদের অতীতের ন্যায় এ বছর গোপনে নোট, গাইড বই বিক্রি করতে হচ্ছে না। বই বিক্রেতারা ওপরের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে আর স্কুলের শিক্ষকদের প্রেসক্রিপশনে (লেখা তালিকা অনুযায়ী) প্রকাশ্যেই এসব নিষিদ্ধ বই চড়া দামে বিক্রি করছেন। এতে করে অবৈধ নোট-গাইড বই বিক্রেতাদের কাছে ছাত্র-ছাত্রীর অভিভাবকরা আজ জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে, জনৈক অভিভাবক ইকবাল হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ক্লাসের ১ম দিনেই বিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে নোট-গাইড বইয়ের তালিকা। আর ওই সব বই কোথায় পাওয়া যাবে সেই লাইব্রেরির নামও ওই তালিকায় লেখা আছে। তালিকায় থাকা ৩টি গাইড বইয়ের দাম প্রায় নয়শ টাকা। যা কি-না অন্য কোনো বইয়ের লাইব্রেরিতে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ়।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক শিক্ষক জানান, আমরা কী করবো। লাইব্রেরিগুলোতে বিভিন্ন প্রকাশনীর নোট ও গাইডবই বিক্রি করা হচ্ছে। আর আমরাও নোট-গাইড বইয়ের তালিকা ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। এর জন্য দায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ প্রকাশনীগুলোর লোভনীয় অফারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ও এনসিটিবি কর্তৃক অনুমোদিত লেখক ও প্রকাশনীর ইংলিশ গ্রামার, রেপিড রিডার ও ব্যাকরণের তালিকা ছাত্র-ছাত্রীদের না দিয়ে তাদের ইচ্ছামতো লাইব্রেরি-প্রকাশনীর ছাপানো নোট-গাইড বইগুলো ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার ওপর প্রকাশনীগুলোর দেয়া টাকার অংক নির্ভর করে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ যতো বেশি ছাত্রছাত্রী ততো বেশি টাকা বা অফার।

এছাড়া বেশ কিছু অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখন স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমন শেখান না। তারা প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। চুয়াডাঙ্গার সরকারি, আধাসরকারি স্কুল, মাদরাসা, কলেজের শিক্ষকদের শতকরা ৮০ ভাগ প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিঙের সাথে জড়িত। স্কুলে পড়াশোনা আগের মতো হয় না। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা গত ৫ বছরের পাবলিক পরীক্ষায় চুয়াডাঙ্গার দুটি সরকারি স্কুলসহ গোটা জেলার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে বলেন এই প্রতিবেদককে। বোর্ডের মেধা তালিকায় তো দূরের কথা খুলনা বিভাগে এক থেকে পাঁচের মধ্যে নেই এখানকার কোনো স্কুল! বিশেষ করে গত জেএসসির ফলাফল বিপর্যয়ের ওপর তারা জোর দেন।

দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, চুয়াডাঙ্গায় এ পর্যন্ত যে সব বিদ্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট বইয়ের তালিকা শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে তা কি ২০১৪ শিক্ষাবর্ষে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত? তা কিন্তু ভাববার বিষয়। এ প্রশ্ন আজ অনেক অভিভাবকের।

আইন কি বলে:  প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোটবই নিষিদ্ধ করে আইন করা হয় ১৯৮০ সালে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকায় নোটবই বাজার থেকে নিষিদ্ধ হয়নি। বরং প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের নোটবইও বাজারে সয়লাব হয়ে যায়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শিক্ষামন্ত্রণালয় নোটবই ছাপানো বন্ধের উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রণালয় ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সরকারের অননুমোদিত নিম্নমানের বই, নোটবই ও গাইডবই বাজারজাত বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনে মোবাইলকোর্টের সাহায্য নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়।

মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আবু তাহের ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনে বলা হয়, বাজারে নোটবই নয়, গাইড বই প্রকাশ করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে।

কিন্তু রিট আবেদনকারীর যুক্তি খণ্ডন করে হাইকোর্ট একই বছরের ১৩ মার্চ ১৯৮০ সনের নোটবই নিষিদ্ধকরণ আইনের আওতায় নোট বইয়ের সাথে গাইডবইও বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে মন্ত্রণালয়ের আদেশ বহাল রাখে। হাইকোর্ট রায়ে বলেন, গাইডবইও নোটবইয়ের অন্তর্ভুক্ত। হাইকোর্টের রায়ের পর রিট আবেদনকারী আপিল করলে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।

নোটবই নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০’র আইনটির ২(খ) ধারায় নোট বইয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বোর্ড বা নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ ছাড়া প্রকাশিত এমন বই যাতে পাঠ্য বইয়ের কোনো বিষয়ের ওপর নোট, ব্যাখ্যা, মন্তব্য বা রেফারেন্স অথবা পাঠ্য বইয়ের কোনো প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান দেয়া থাকে অথবা পাঠ্য বইয়ের কোনো বিষয় বা অধ্যায়ের অনুবাদ অন্তর্ভূক্ত হয়।

৩(১) ধারায় নোটবই ছাপানো, প্রকাশ, আমদানি, বিক্রি বিতরণকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ আইন লঙ্ঘন করলে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ড দেয়ার বিধান আছে।