বঙ্গোপসাগরের তালপট্টি পাচ্ছে কোন দেশ : রায় ঘোষণা৮ জুলাই

 

 

স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গোপসাগরে২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের বিরোধপূর্ণ জলসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি করে হেগশহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালত রায় ঘোষণা করবে ৮ জুলাই মঙ্গলবার। এতেবাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হচ্ছে। তবে এ রায়ে সবারদৃষ্টি থাকবে অধুনা সাগরের ঢেউয়ের নিচে হারিয়ে যাওয়া দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকোন দেশ পায় তার প্রতি।হাড়িভাঙ্গা নদীর মোহনা থেকে মাত্র দুকিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেবিরোধ রয়েছে। ভারতে এই দ্বীপের নাম নিউমোর। পলি জমে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠাএই দ্বীপে কোনো জনবসতি গড়ে ওঠেনি। তবে মনে করা হয়, সাগরের ওই অঞ্চলে তেল ওগ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অঞ্চলটি উভয় দেশই পেতে চায়। ১৯৪৭সালে ভারত ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করে রেডক্লিফ যেরেখা টানেন তার কারণেও এই বিরোধের সৃষ্টি হয়। হাড়িভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোতকেপূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত রেখা হিসেবে উল্লেখ করেন রেডক্লিফ।

দক্ষিণতালপট্টি দ্বীপের জন্ম হয় ১৯৭০ সালে ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে। ১৯৭৪ সালেএক মার্কিন স্যাটেলাইটে ২৫০০ বর্গমিটারের (২৭,০০০ বর্গফুট) এই দ্বীপেরঅস্তিত্ব ধরা পড়ে। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা ও ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলারমাঝামাঝি এই দ্বীপের অবস্থান। ১৯৮১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফএই দ্বীপে ভারতের পতাকা ওড়ায় এবং একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। তারপরসেখানে ভারতীয় নৌবাহিনীর গানশিপ নিয়মিত চলাচল করে। ২০১০ সালে কলকাতারযাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুগাতা হাজরা ঘোষণা করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেসমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় এই দ্বীপের এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই।সমুদ্রের স্রোতের নিচে হারিয়ে গেছে দ্বীপটি।

দক্ষিণ তালপট্টি ছাড়াও এইরায়ে বাংলাদেশ মহীসোপানের অধিকার পায় কিনা সেটির প্রতিও সবার বিশেষ দৃষ্টিথাকছে। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার রায়ে অবশ্য বাংলাদেশকে মহীসোপানেরঅধিকার দেয়া হয়েছে।ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত মামলাররায় ঘোষণা করবে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে অবস্থিত পার্মানেন্ট কোর্ট অবআরবিট্রেশন। এ রায়ের ফলে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির দীর্ঘপ্রতীক্ষার অবসান হচ্ছে। ইতঃপূর্বে ২০১২ সালে জার্মানির হামবুর্গেসমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের সাথেসমুদ্রসীমা বিরোধের রায় দেয়। ফলে ভারতের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তির রায়ের পরসমুদ্রসীমা নিয়ে কোনো দেশের সাথেই আর বাংলাদেশের বিরোধ থাকবে না।বাংলাদেশসমুদ্রসীমা নির্ধারণে ন্যাযতাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করার দাবিজানিয়েছে। যদিও ভারত বলেছে, সমদূরত্বের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতেহবে। রায়ে দেখা যাবে হেগের আদালত কোন পদ্ধতিকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণেরভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার মামলা নিষ্পত্তিহয়েছে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত সালিশ আদালত ইটলসে। কিন্তু ভারতের সাথেমামলা পরিচালিত হয়েছে নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আদালতে পার্মানেন্টকোর্ট অব আরবিট্রেশন।

বাংলাদেশের মোট সমুদ্রসীমা এক লাখ ১১ হাজারবর্গকিলোমিটারের বেশি। তার মধ্যে মিয়ানমারের সাথে রায়ে বিরোধ নিষ্পত্তিহওয়ায় সেখান থেকে ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল পেয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্বসমুদ্র অঞ্চল আছে প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এখন ভারতের সাথেবিরোধপূর্ণ অঞ্চল আছে ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার। ভারতের সাথে সমুদ্রসীমাচূড়ান্ত রায় পাওয়ার পর বাংলাদেশের মোট সমুদ্র অঞ্চলের পরিমাণসুনির্দিষ্টভাবে জানা যাবে। ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত রায়কে সামনেরেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম ইউনিটের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.)মো. খুরশেদ আলম বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকেবিস্তারিত তথ্য অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রায় যাতেবাংলাদেশের পক্ষে আসে সেজন্য দেশবাসীকে দোয়া করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।তবে এবার রায়কে নিয়ে বড় কোনও শোরগোল করবে না সরকার। মিয়ানমারের সাথেসমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে এটাকে বাংলাদেশেরবিপুল বিজয় হিসেবে দাবি করা হয়। এখন সরকারের দায়িত্বশীল মহলের তরফে বলাহচ্ছে যে, ওই দাবি ছিলো অপরিণামদর্শী। কেননা আন্তর্জাতিক আদালতে এ ধরনেরমামলায় কোনো একপক্ষ জয়ী হয় না। বরং বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এ মামলায় কোনওআপিলের সুযোগ নেই। ভারতের সাথে মামলার রায়ের পর তা মেনে নিয়ে তাই সরকারসংযত ও সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে মনে হচ্ছে। রায় নিয়ে তৃতীয় কোনো মহলযাতে সুযোগ নিতে না পারে সেজন্য কোনো প্রকার বিজয় উদযাপন কিংবা হতাশাব্যক্ত করা হবে না। হেগের আদালতে রায়ের শুনানি গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর শেষহয়। রুলস অব প্রসিডিউর অনুযায়ী, এ মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার ছয় মাসেরমধ্যে হেগের সালিশ আদালত মামলাটির রায় দেয়ার কথা। সেই মোতাবেক, জুনের ১৮তারিখের মধ্যে রায় হওয়ার কথা ছিলো। এক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্বে রায় দেয়াহচ্ছে। রায়ে হেগের আদালত ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণী কয়েকটি বিষয়েবিশেষ করে দুই দেশের জলসীমা শুরুর স্থান নির্ধারণ, রাষ্ট্রাধীন সমুদ্রঅঞ্চল চিহ্নিতকরণ, একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ওতার বাইরে মহীসোপানের বিষয়ে রায়ে উল্লেখ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। কেননাশুনানিকালে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় পক্ষ থেকে সালিস ট্রাইব্যুনালের কাছে এসববিষয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এ সময়ে ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের জবাবওদিয়েছে উভয় পক্ষ।

সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়ে চার দশকের বেশি সময়দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেও ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতেপারেনি বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার দিটেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম জোন্স অ্যাক্ট প্রণয়ন করে। এর মাধ্যমেএকটি বেসলাইন, ১২ নটিক্যাল মাইলের সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলেরঅর্থনৈতিক অঞ্চল এবং কন্টিনেন্টাল মার্জিন পর্যন্ত মহীসোপান ঘোষণা করা হয়।

১৯৮২সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন আনক্লস স্বাক্ষরিত হয়। এআইনের অধীনে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০১ সালের ৯জুলাই তৎকালীন সরকার এই কনভেনশনটি অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ আইনএকটি উপকূলীয় দেশকে ১২ নটিক্যাল মাইল রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র অঞ্চলে পূর্ণসার্বভৌমত্ব এবং ২৪ নটিক্যাল মাইল সন্নিহিত অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলএকচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইউজেড) এবং ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরেমহীসোপানের সমুদ্র সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রদান করেছে।বাংলাদেশ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আনক্লস-১৯৮২ এর অধীনে ভারত ও মিয়ানমারকে সালিসনিষ্পত্তির নোটিশ দেয়। উভয় প্রতিবেশী দেশ এই প্রক্রিয়ার অনুকূলেইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়। সালিস নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণের পর মিয়ানমারেরপ্রস্তাব ও বাংলাদেশের সম্মতিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার মামলাটিআনক্লসের আওতায় প্রতিষ্ঠিত ও জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত স্থায়ী বিচারিকপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দি ল অব দি সি (ইটলস) এ পাঠানোহয়। এ মামলার লিখিত আরজি দাখিলের পর চূড়ান্ত রায় দেয়া হয় ২০১২ সালের ১৪মার্চ। মিয়ানমারের সাথে মামলার রায় মোতাবেক, সেন্টমার্টিন্স দ্বীপ থেকে ২২কিলোমিটার রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র অঞ্চল, ৩৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত একচ্ছত্রঅর্থনৈতিক অঞ্চল এবং তার বাইরেও মহীসোপানের ওপর সব প্রাণিজ এবং খনিজসম্পদেরওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে।