ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ছয়টি স্থানে সন্ত্রাসী হামলায় ১২৮ জন নিহত

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: হয়তো তখন প্যারিসের বেশিরভাগ মানুষ ঘুমিয়ে ছিলো। তারা জানতো না তাদের শহরে কি ঘটতে যাচ্ছে। মানবতার শত্রুদের তাণ্ডবলীলা কতোটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করবে। এই সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া হামলায় ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গত শুক্রবার মধ্যরাতে ১২৮ জন নিহত ও দু শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৮০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। শহরের কয়েকটি এলাকা এবং স্টেডিয়ামে প্রায় একই সময় ওই হামলার ঘটনা ঘটে। এ সন্ত্রাসী হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে আইএস (ইসলামিক স্টেট)। ফ্রান্সে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। প্যারিসে কারফিউ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ঘোষণা করা হয়েছে তিন দিনের জাতীয় শোক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সীমান্ত। প্যারিসের মানুষকে রাস্তায় বের হতে বারণ করা হয়েছে। সংঘর্ষে অন্তত ৮ হামলাকারী নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। পুলিশকে সহায়তা করতে কমপক্ষে দেড় হাজার সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। প্যারিস ভ্রমণে বেলজিয়ামের নাগরিকদের সতর্কতা জারি করেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিচেল। প্যারিসে হামলার ঘটনায় কোনো বাংলাদেশি হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

প্যারিসে বাতিল হয়েছে পুলিশের ছুটি, হাসপাতালগুলোতে কর্মীদের নিরবচ্ছিন্ন কাজে রাখা হয়েছে। মেট্রো রেলের পাশাপাশি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মার্কেট, জাদুঘর, পর্যটন স্পটও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শহরে শুধু চালু রয়েছে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন। তবে দূরপাল্লার রেল ও বিমান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

জার্মানির বিপক্ষে ফ্রান্সের ফুটবল টিমের খেলা চলার সময় স্টেড দ্য ফ্রান্স নামের স্টেডিয়ামটিতে বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া গেছে। সে সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলান্দ স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছিলেন।

বাইরে বোমা হামলার পর খেলা চালিয়ে গেলেও স্টেডিয়ামের ভেতরে আতঙ্ক তৈরি হয়। ওই সময় গ্যালারিতে ওলান্দের সাথে বসে খেলা দেখছিলেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্যাংক ভালটার। বিস্ফোরণের পরপরই পুলিশের হেলিকপ্টারকে স্টেডিয়ামের ওপর চক্কর দিতে দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট ওলান্দ দ্রুত চলে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, সেখানে বসে সব পরিস্থিতি রেদখে জরুরি অবস্থার ঘোষণা দেন তিনি। বিবিসির এক সংবাদদাতা জানিয়েছেন, তিনি শহরের একটি এশিয়ান রেস্তোরাঁর সামনে অন্তত ১০ জনকে পড়ে থাকতে দেখেছেন।

এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, তিনি একজন বন্দুকধারীকে আধা স্বয়ংক্রিয় বন্দুক দিয়ে গুলি চালাতে দেখেছেন।

ফ্রান্স পুলিশ জানিয়েছে, বাতাক্লান কনসার্ট হলে ১৫ জনকে হত্যা এবং ৬০ থেকে ১০০ জনের মতো লোককে জিম্মি করে অস্ত্রধারীরা। আমেরিকার একটি ব্যান্ড দলের কনসার্ট চলছিলো তখন। হত্যা ও জিম্মির ঘটনার পর পুলিশ কনসার্ট হলের চারপাশ ঘিরে রাখে। পরে পুলিশ জিম্মিদের উদ্ধারে ভারী অস্ত্রসহকারে সন্ত্রাসীদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ৩ অস্ত্রধারী মারা যায় এবং শুক্রবার মধ্যরাতে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয় পুলিশ। এ ঘটনায় ১০০ জনের মতো লোক মারা গেছেন। কনসার্ট হলে বিপুল হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছে। ফলে প্রথমদিকে মৃতের যে সংখ্যা ঘোষণা করা হয়েছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি লোক এতে মারা গেছেন।

মধ্য প্যারিসে অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে একজন বন্দুকধারী গুলি চালিয়ে ১১ জনকে এবং প্যারিসের স্ট্যাড ডি ফ্রান্স স্টেডিয়ামের পাশে বোমা বিস্ফোরণে ৩ জন নিহত হয়েছেন। তবে কেউ কেউ বোমা বিস্ফোরণকে আত্মঘাতী হামলা বলে বর্ণনা করেছেন।

শহরের মাঝামাঝি বাটাক্লান কনসার্ট হলে মার্কিন ব্যান্ড দল ইগলস অব ডেথ মেটালের কনসার্ট দেখতে জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। এরই মধ্যে অন্তত তিন হামলাকারী হলে ঢুকে কালাশনিকভের মতো দেখতে রাইফেল নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে।

সাংবাদিক জুলিয় পিয়ার্সের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তারা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিলো। যে যেদিকে পারে দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছিলো। আমি বহু মানুষকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখেছি। জুলিয় পিয়ার্স বলেন, হামলাকারীরা সবাই ছিলো বয়সে তরুণ। কারো মুখে মুখোশ ছিলো না। অন্তত তিনবার তারা রাইফেলের ম্যাগাজিন বদলেছে। কনসার্ট হলের বাইরে থাকা এক যুবক বলেন, বন্দুকধারী তিন তরুণ ছিলো কালো পোশাকধারী। তাদের হাতে ছিলো মেশিনগান।

এ ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের পর হামলাকারীরা সেখানে শতাধিক মানুষকে জিম্মি করে। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে জিম্মি সঙ্কটের রক্তাক্ত অবসান ঘটায়। ওই কনসার্ট হলের কয়েকশ মিটারের মধ্যে বিদ্রুপ সাময়িকী শার্লি এবদুর কার্যালয়। ১০ মাস আগে সেখানে বন্দুকধারীরা হামলা চালিয়ে ২০ জনকে হত্যা করেছিলো। স্টেডিয়ামের বাইরে ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানের সামনে দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। রেস্তোরাঁর বাইরের অংশে তখন অনেকেই ডিনার খেতে বসেছিলেন।

আইএস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইরাক-সিরিয়ায় হামলার বদলা নিতে প্যারিসে হামলা চালানো হয়েছে। এদিকে ভ্রমণ সতর্কতায় বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে আমাদেরকে প্যারিস ভ্রমণ এড়িয়ে চলতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি আমার দেশের নাগরিকদের একটি বার্তা দিচ্ছি। ২০০৪ সালে মাদ্রিদে ট্রেনে বোমা হামলার পর ইউরোপে এটাই সন্ত্রাসী হামলার সবচেয়ে বড় ঘটনা।