ফেনীর ফুলগাজি উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে ও পেট্রোলে পুড়িয়ে খুন

 

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ: বিএনপি নেতার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ : বিজিবি মোতায়েন

স্টাফ রিপোর্টার: ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হকএকরামকে (৪৮) প্রকাশ্য দিবালোকে গাড়িতে হামলা চালিয়ে গুলি করার পর পুড়িয়েহত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে ফেনীর জিএএকাডেমী রোডের বিলাসী সিনেমার হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ফুলগাজী সদরইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন সামু (৬০), দৈনিক ফেনীপ্রতিদিনপত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মহিবুল্লাহ ফরহাদ (৩২), নিহতের বন্ধুদেলোয়ার হোসেন (৪৫) ও গাড়িচালক মামুন (৩০) গুরুতর আহত হয়েছেন।
এ রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের পর জেলা শহরটিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আওয়ামী লীগনেতাকর্মীসহ জনগণ। বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের একাডেমি এলাকায় কয়েকটি দোকান এবংযানবাহনে ভাঙচুর চালায়। তীব্র আতঙ্কে মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় শহরেরভেতরে সব ধরনের যান চলাচল। খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে দফায় দফায় বিক্ষোভমিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনগণঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়।ফুলগাজীতেও একরাম সমর্থকদের অবরোধে বন্ধ হয়ে যায় জেলার সাথে পরশুরামউপজেলার সড়ক যোগাযোগ। ফুলগাজীর আনন্দপুরে বিএনপি নেতা মিনার চৌধুরীর বাড়িতেবিক্ষুব্ধ জনতা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনায়জেলা ও উপজেলাজুড়ে থমথমেঅবস্থা বিরাজ করছে।
শুধু ফেনীবাসীই নয়, অত্যন্ত জনপ্রিয় এ তরুণ নেতার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভপ্রকাশ করে অবিলম্বে খুনিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসাঁড়াশি অভিযান শুরু করলেও হত্যায় জড়িত কাউকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্তগ্রেফতার করতে পারেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফেনী ও ফুলগাজীতে দু প্লাটুনবিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, সকাল পৌনে ১১টার দিকে ফুলগাজী উপজেলাচেয়ারম্যান একরামুল হক প্রতিদিনের মতো শহরের মাস্টারপাড়ার বাসা থেকে সরকারিজিপে ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের দিকে রওনা দেন। এ সময় তার সাথে ছিলেনফুলগাজীর সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সম্বু চেয়ারম্যানসহ মোট তিনজন। গাড়িটিএকাডেমী এলাকার বিলাসী সিনেমা হলের সামনে পৌঁছুলে আগে থেকেই ওত পেতে থাকাএকদল দুর্বৃত্ত তাদের গাড়িতে আকস্মিক আক্রমণ চালায়। কয়েকটি হাতবোমারবিস্ফোরণ ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপে একরামকে বহনকারী জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েপাশের আইল্যান্ডে উঠে পড়ে।
এ সময় সন্ত্রাসীরা গাড়িটি ঘেরাও করে প্রথমে উপজেলা চেয়ারম্যানকে টার্গেটকরে খুব কাছ থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। এর পর রক্তের নেশায় উন্মত্তসন্ত্রাসীরা গুলিবিদ্ধ একরামকে গাড়ির ভেতরে আটকে রেখে পেট্রোল ঢেলে আগুনধরিয়ে দেয়। গাড়িতে আগুন দেয়ার আগে গাড়িচালকসহ একরামের সাথে থাকা তিনজনকেপিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে তারা। গাড়িতে আগুন দিয়ে সদর্পে খুনিরা পালিয়ে যায়।আর গাড়িতেই আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেন জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম।
প্রকাশ্য দিবালোকে নিষ্ঠুর ও লোমহর্ষক এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সন্ত্রাসীরা চলেযাওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে। দমকলবাহিনী এসেগাড়িতে লাগানো আগুন নিভিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত একরামুল হকের লাশ উদ্ধারকরে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গাড়িটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে, তার লাশ পড়ে আছেদরজার পাশে। লাশটি পুড়ে এতোটাই বিকৃত হয়েছে যে চেনার জো নেই। পুলিশ একরামেরলাশটি গাড়ি থেকে বের করে আনার পর ময়নাতদন্তের জন্য ফেনী সদর হাসপাতালমর্গে পাঠায়।
একরাম হত্যাকাণ্ডের খবরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে কয়েকটি গাড়িও দোকান ভাঙচুর করে। এ সময় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুরো শহরে যানবাহনচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জেলা আওয়ামী লীগ শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এর মধ্যেএকদল নেতাকর্মী বিকেল ৩টার দিকে মহিপালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করলেযানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতাকে সরিয়েদেয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা শহরে পুলিশ, র‌্যাবের পাশাপাশি দু প্লাটুনবিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। একরাম সমর্থকরা ফুলগাজীতে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিকসড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করে রেখেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।মঙ্গলবার বিকেলে একরামের সমর্থকরা ফুলগাজীর আনন্দপুরে বিএনপি নেতা মিনারচৌধুরীর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডদাবি করেছেনজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুর রহমান এবং জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক দিদারুলকবির রতন। তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। পাশাপাশিঅবিলম্বে খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
একরাম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জেলা আওয়ামীলীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে তিনদিন দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন ওদলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, একরাম জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন ছাড়াও ঠিকাদারীব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ফেনী ডায়াবেটিকহাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক এবং দৈনিক ফেনী প্রতিদিন এর মালিক-সম্পাদকছিলেন। বেশ কয়েকমাস পূর্বে একটি তুচ্ছ ঘটনায় ফেনী ডায়বেটিক হাসপাতালে তালালাগিয়ে দেয় তার নিজ দলীয় এক প্রভাবশালী নেতার সমর্থকরা। এ ঘটনাসহ বিভিন্নকাজের ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে তিনি দলীয় এক প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের সাথেদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যদিও ওই সংসদ সদস্য ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ আওয়ামীলীগ সমর্থকদের কাছে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের আশ্বাস দিয়েছেন।
তবে কেবা কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। ফেনীজেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, সন্ত্রাসী যেই হোকনা কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের গ্রেফতার করবে। জেলা পুলিশ সুপারপরিতোষ ঘোষ বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানের হত্যাকারীদের শনাক্ত করে দ্রুতগ্রেফতার করা হবে। ফেনীর এএসপি (সার্কেল) শামছুল আলম জানান, ঘটনাটি দলীয়কোন্দলের জের কি-না তা তদন্তের পরে বলা যাবে।জেলা আওয়ামী লীগেরসভাপতি আব্দুর রহমান এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ ঘটনার সাথে যারাজড়িত রয়েছে তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।
নিহত উপজেলাচেয়ারম্যানের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, নিহতের স্ত্রী তাসমিন আক্তারসহপরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। তারা এখন শোকে মূহ্যমান। এ ঘটনায় মামলাদায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন ফেনী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ। নিহত একরামুলের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করেচট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। এর রিপোর্ট লেখাপর্যন্ত রাত ১১টায় তার লাশ ডিএনএ পরীক্ষা শেষে ফেনীর উদ্দেশে রওয়া হয়।
এদিকেআজ বুধবার সকাল ৯টা মিজান ময়দান মাঠে মরহুমের প্রথম জানাজা এবং ১১টায় দ্বিতীয়জানাজা ফুলগাজী পাইলট স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুরকাদের জানাজায় উপস্থিত থকবেন।
রাষ্ট্রপতির নিন্দা ও শোক: এদিকেএ হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। গতকাল একশোক বিবৃতিতে রাষ্ট্রপতি নিহতের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীরসমবেদনা জানান। এছাড়া শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন যোগাযোগ মন্ত্রীওবায়দুল কাদের।