ফেনসিডিল চালানের বিনিময়ে আনা হচ্ছে ইয়াবা ট্যাবলেটের চালান

চুয়াডাঙ্গায় কোনভাবে বন্ধ করা যাচ্ছেনা মাদকদ্রব্য বিকিকিনি

দর্শনা অফিস: চুয়াডাঙ্গার বদনাম ঘুচাতে জেলা পুলিশ একবার ব্যার্থ হলেও এবার ব্যার্থতার দায়ভার বহন করতে যেনো নারাজ। যেকোনো মূল্যে জেলাকে মাদকমুক্ত করণের লক্ষ্যে বর্তমান পুলিশ সুপার যেনো কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। মাস কয়েক আগে পুলিশের চোখ ফাকি দিয়ে আত্মসমর্পনের নামে মাদককারবারীরা নাটক করলেও এবার হয়তো সে সুযোগ দেবেনা পুলিশ। মাদকমুক্ত ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রজন্ম তথা চুয়াডাঙ্গা গড়তে পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ লাগাতার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এতকিছুর পরও কমেনি, কমছে না মাদক কারবার। পুলিশ অভিযানের কৌশল পাল্টানোর সাথে সাথে মাদক কারবারিরা বদলাচ্ছে তাদের কৌশল। প্রতিমূহূর্তে নয়া কৌশলে করা হচ্ছে মাদকদ্রব্য বিকিকিনি। ঐতিহ্যবাহি একটি জেলার নাম চুয়াডাঙ্গা। অথচ গুটি কয়েক শ’ মাদককারবারীর কারণে এ জেলার সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকা-। মাস কয়েক আগে জেলা পুলিশের আহ্বানে নামকাওয়াস্তে আতœসমর্পনের নাটক করে এলাকার মাদককারবারীরা। যদিও আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণকালে পুলিশ কর্তৃক মাদককারবারীদের পূর্ণবাসনের আশ্বাস দিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত পুলিশ যেমন পারেনি তাদের কথা রাখতে, তেমনই আতœসমর্পনের নামে গায়ের কালি মুছে, ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নতুন ইমেজে পুরোদমে মাদক কারবার শুরু করে কারবারীরা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে জেলা পুলিশের কর্তার চেয়ার। নতুন কর্তা নতুনভাবে গ্রহণ করেছে মাদকমুক্ত চুয়াডাঙ্গা গড়ার উদ্দ্যোগ। সে লক্ষ্যেই মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখা হলেও উল্লেখযোগ্য হোতাদের মধ্যে তেমন কাউকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া যায়নি। চুনোপুটি ও বহনকারীরা গ্রেফতার হওয়ায় রাঘববোয়ালেরা নতুন করে লোকবল নিচ্ছেন। ফলে মাদক কারবারের পরিধি থেকে যাচ্ছে অপরিবর্তিত।
অভিযোগ রয়েছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, কাভার্ডভ্যান, ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে ফেনসিডিলের বড় বড় চালান নেয়া হচ্ছে রাজধানী শহর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বহনে অতি সহজ হওয়ায় ঢাকা, চিটাগাং, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, রংপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলা শহর থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট আনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলেছে, ফেনসিডিলের পরিবর্তে ইয়াবা ট্যাবলেট চুয়াডাঙ্গায় আনছে মাদককারবারীরা। মাদকদ্রব্য পাচারের জন্য বেশ কয়েকটি রুট ব্যবহার করছে মাদক কারবারীরা। রুটগুলোর মধ্যে অন্যতম রুট ১ : জীবননগর উপজেলার বেনীপুর, মেদেনীপুর গয়েশপুর, হরিহরনগর, রাজাপুর থেকে জীবননগর-হাসাদহ-খালিশপুর-কোটচাঁদপুর হয়ে কালীগঞ্জ। রুট ২ : একই এলাকা থেকে জীবননগর-হাসাদহ-কাটাপোল-বালীহুদা-আন্দুলবাড়ীয়া-খাড়াগোদা-সরোগঞ্জ ও বদরগঞ্জবাজার হয়ে কালীগঞ্জ। রুট ৩ : একই এলাকা থেকে জীবননগর-উথলী-দোস্ত-হিজলগাড়ী-খাড়াগোদা-সরোজগঞ্জ ও বদরগঞ্জবাজার হয়ে ঝিনাইদহ। রুট ৪ : দর্শনা, নিমতলা, জয়নগর, সুলতানপুর, কামারপাড়া, সিংনগর থেকে দোস্ত-হিজলগাড়ী-খাড়াগোদা-সরোজগঞ্জ ও বদরগঞ্জ বাজার হয়ে ঝিনাইদহ। রুট ৫ : একই এলাকা থেকে দোস্ত-হিজলগাড়ী-খাড়াগোদা-সরোগঞ্জ ও বদরগঞ্জ বাজার হয়ে ঝিনাইদহ। রুট ৬ : একই এলাকা থেকে দামুড়হুদা-চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা হয়ে পোড়াদহ, কুষ্টিয়া ও ভেড়ামারা। রুট ৭ : ঠাকুরপুর, মুন্সিপুর, পীরপুরকুল্ল¬া থেকে কার্পাসডাঙ্গা-চিতলার মোড়-কলাবাড়ী রামনগর-ভালাইপুর মোড়-আসমান খালী-হাটবোয়ালিয়া-কাতলামারী হয়ে মিরপুর ও ভেড়ামারা। চুয়াডাঙ্গা জেলার সর্বচ্চ মাদককারবারী রয়েছে, দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা, সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া, রাঙ্গিয়ারপোতা ও সিংনগরে। মাদককারবারীর সংখ্যা সঠিক হিসেব করা মুশকিল। কারণ হিসেবে জানা গেছে, প্রতিদিনই যেনো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে মাদককারবারীরা। অভিযোগ রয়েছে, মাদক কারবারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে থাকে কেউ কেউ। অনেকেই ক্ষমতাশীনদের ছত্রছায়ায় এ কারবার করছে পুরোদমে। ফলে মাদক কারবারীদের পাশাপাশি তাদের প্রশ্রয়দাতাকে চিহ্নিত করে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করতে প্রতিবেশী দেশ আবিস্কার করলো ফেনসিডিল নামক মাদকজাত। প্রায় ১ যুগ আগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যাক্তি সিমান্তের তার কাটা বেড়া ডিঙিয়ে বাংলাদেশে আনতে শুরু করে ফেনসিডিল ও হেরোইন। নামকাওয়াস্ত মূল্যে ফেনসিডিল বিক্রি হলেও এ নেশা যুবসমাজে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। সেই সাথে হেরোইন মারণ নেশা ও ফেনসিডিল ধ্বংসাত্মক ভয়ঙ্কর নেশায় পরিণত হয়েছে। ফেনসিডিল ও হেরোইন পাচারের ক্ষেত্রে চুয়াডাঙ্গার প্রায় সবকটি সিমান্ত পথ বেছে নেয় মাদককারবারীরা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সিমান্ত পথে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে এ মাদককারবার শুরু হলেও চুয়াডাঙ্গা জেলায় ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। ভারত থেকে ফেনসিডিল ও হেরোইন বহন করে আনার পথে সিমান্তে বিএসএফ’র গুলি ও নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে অনেক বাংলাদেশি। অনেকেই করেছে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন। অনেকেই করছে কারাবরণ। ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলো মাদক পাচারকারিচক্রের হোতারা। সে সময় ভারত থেকে প্রতিবোতল ফেনসিডিল কিনে আনা হতো মাত্র ১০-১২ টাকায়। সে ফেনসিডিল এখন ভারত থেকে কিনে আনতে হচ্ছে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা বোতল। ফেনসিডিল বহনের ক্ষেত্রে জোনহাজিরাসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবোতল সর্বসাকুল্যে খরচ হয় ২শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকা পর্যন্ত। সিমান্ত পার করে আনার পরপরই এ ফেনসিডিল পাইকারি কারবারীদের কাছে প্রতিবোতল বিক্রি করা হয়ে থাকে ৩শ’ টাকায়। বর্তমানে ফেনসিডিলের আখড়ায় খুচরা বিক্রি করা হয়ে থাকে ৫ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকায়। এ ফেনসিডিল রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়ে থাকে ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকায়। ইয়াবা ট্যাবলেট এক ধরনের নেশা জাতীয় ট্যাবলেটের নাম। এটি মূলত মেথঅ্যাম্ফিটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইয়াবা ট্যাবলেটের সাথে হেরোইন মেশানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি খাওয়ার বড়ি হিসেবে ব্যাবহৃত হতো। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধাতবদ্রব্য ও কাগজের মাধ্যমে পুড়িয়ে ধোয়া হিসেবে সেবন করা হয়ে থাকে। ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের সাথে সাথে মানবদেহ অতিমাত্রায় উত্তেজিত হওয়ার কারণে শারীরিক শক্তি বর্ধিত হয়েছে বলে অনুভূত হয়। যে কারণে দীর্ঘসময় নির্ঘূম থাকতে পারে সেবনকারি। এতে ক্ষুধা ও মানষিক ভারসাম্য লোপ পেতে থাকে। এ নেশা কয়েক ঘন্টা থাকার পর ধীরে ধীরে তা কেটে যায়। ফলে শরীর মন ভেঙে দুর্বলতা অনুভূত হয়। ইয়াবা সেবনকারীরা ধীরে ধীরে মানসিকতা ও ধৈর্য্যশীলতা হারায়। এতে প্রচ-ভাবে দীর্ঘমেয়াদী শারিরীক ও মানসিক ক্ষতি হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বড় ইয়াবা ট্যাবলেট সংগ্রহ করা হয়ে থাকে ১২০ টাকা ও ছোটগুলো প্রতিটি ৬০ টাকায়। চুয়াডাঙ্গাতে এনে প্রতিটি বড় ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি করা হয় ২৫০ টাকা ও ছোটগুলো ১২০ টাকায়। মারণনেশা ইয়াবা ট্যাবলেট, হেরোইন ও ফেনসিডিল বন্ধে চুয়াডাঙ্গা পুলিশের পাশাপাশি গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ তথা জাতিকে মাদকের কড়াল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে পুলিশ প্রসাশনকে সর্বক্ষনিক সহায়তার হাত বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই আসুন মাদককে না বলি, প্রশাসনকে সহায়তা করি।