ফুরিয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি : বছরে নষ্ট হচ্ছে দু লাখ একর

স্টাফ রিপোর্টার: ফুরিয়ে যাচ্ছে ‘সোনা ফলানো’ কৃষিজমি। অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, নগরায়ণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, পুকুর খনন, মাছচাষ ও নদী ভাঙনের ফলে বছরে কমছে দু লাখ একর কৃষিজমি। আবার নগদ টাকার লোভে জমি বিক্রি করে বাস্তুহারা হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা। প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে বাসগৃহ-দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট।

পরিকল্পনাহীন নগরায়ণের ছোবলে কৃষি হারাচ্ছে বৈচিত্র্যও। কোথাও গড়ে উঠছে আবাসন, কোথাও হচ্ছে শিল্প কারখানা। এমনকি ইটভাটার জন্যও প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূল এলাকায় ধানের জমিতে বাঁধ দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কোথাও কোথাও হচ্ছে লবণের উৎপাদন। নানাভাবে কৃষিজমি অনুৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে ব্যবহার চলছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দশকে দেশে কৃষিজমির ব্যাপক সংকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্ট সব গবেষণার ফলাফলেই কৃষিজমি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া এবং অচিরেই বিপন্নতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিপন্নতা মোকাবিলায় সরকারের কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেই। নেই আধুনিক বাস্তবসম্মত কোনো আইন। পাশের দেশ ভারতে যখন জমি অধিগ্রহণ নিয়ে রক্তারক্তি হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে নীরবে চলছে কৃষিজমি নিধন, আবার তা সরকারি উদ্যোগেও।

স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পড়ছে। তার প্রভাব পড়ছে ফসলি জমির ওপর। পরিবার বিভক্ত হলে তার প্রথম ধকলটিই পড়ে কৃষিজমিতে। এক বাবার চার সন্তান পৃথক হওয়ার পরক্ষণেই আবাদি জমিতে যার যার বাড়িঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ দেখা যায়। অনেকে চাকরির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষিজমির কোনো প্রয়োজনবোধ করছেন না। এর পরও আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল। প্রতি বছর নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে সহস্রাধিক হেক্টর জমি। আবাসন ও নির্মাণকাজে চলে যাচ্ছে কম-বেশি আরও তিন হাজার হেক্টর। গত ৩৭ বছরে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে ৬৫ হাজার একর কৃষিজমিতে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, বছরে যে পরিমাণ কৃষিজমি কমছে, তার অর্ধেকই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ৬৫ শতাংশ জমির উর্বরা শক্তিও হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এখনই কৃষিজমি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। বিআইডিএসের গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, কৃষিজমি কমে গিয়ে অনুৎপাদন খাতে চলে যেতে থাকলে জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষি খাতে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে।

জানা গেছে, দু-তিন ফসলি জমিতে মাটি ভরাট করে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি ও শিল্প কারখানা। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির ফলে ফসল উৎপাদনব্যবস্থা প্রশংসনীয় হলেও ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১ কোটি লোক দিনে তিন বেলা খেতে পারে না। মানবসৃষ্ট এই বিপর্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ- দুটোই আগামীর খাদ্য সংকটকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগেও কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে : শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে তা নয়, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কারণেও কমছে কৃষিজমি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র ছাড়াও এলএনজি টার্মিনাল, এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, সাগরে জ্বালানি তেলের ভাসমান ডিপো ও পাইপলাইন (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) স্থাপন বাবদ আরও প্রায় ছয় হাজার একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত রয়েছে। কৃষিজমি যে কেউ যে কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই। এজন্য আইন পরিবর্তন করে উর্বর ও কৃষি উপযোগী জমির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা বার বার বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো বিধিবিধান এ পর্যন্ত করা যায়নি।

জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি-২০১০ এবং কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি জোনিং আইন-২০১০ অনুযায়ী কৃষিজমি কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কোনো কৃষিজমি ভরাট করে বাড়িঘর, শিল্প কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা কোনোভাবেই নির্মাণ করা যাবে না উল্লেখ করে একটি নামমাত্র আইন থাকলেও এর শাস্তির বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ যত্রতত্র ইটভাটায়: গ্রামাঞ্চলে কৃষিজমির সবচেয়ে বড় সর্বনাশ ঘটাচ্ছে ইটভাটাগুলো। ৮ থেকে ১০ একর জমি ধ্বংস করেই এসব ইটভাটা গড়ে ওঠে। ইটভাটার জন্য মাটিও কেটে নেয়া হয় আবাদি জমি থেকে। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবে ইটখোলা আছে ৪ হাজার ৫১০টি। তবে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ইটখোলার সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। এসব ইটখোলায় বছরে অন্তত সাড়ে ১৩ কোটি টন মাটি লাগে, যে কারণে বছরে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমি ২ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেয়া হয়। সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় মাছ চাষ একটি বৃহত্তম কৃষিভিত্তিক খামারে পরিণত হয়েছে। মাছের এ খামারগুলো গড়ে উঠেছে কৃষিজমিতে। বিভিন্ন জেলা শহরের আশপাশে যত্রতত্র গড়ে উঠছে আবাসন প্রকল্পসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ঢাকার আশপাশের ভূমির চিত্র ঠিক একই রকমের। যাত্রাবাড়ী-ডেমরা-আশুলিয়াসহ আশপাশের এলাকায় রয়েছে বিশাল বিশাল জলাশয়সহ কৃষিজমি। মাটি দিয়ে নির্বিচারে ভরাট করা হচ্ছে এসব জমি। অনেক জমি কেনার পর বাউন্ডারি করে রাখা হয়েছে।

এক নজরে কৃষিজমির হালচাল: ভূমি জরিপ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমি দু কোটি ১৭ লাখ হেক্টর; যা ১৯৮৬ সালে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টরে এবং ২০০৩ সালে আরও কমে দাঁড়ায় ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ। ২০০০ সালে ১৩ কোটি এবং বর্তমানে ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ২০ বছরে গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখই দরিদ্র। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ১১ কোটিই গ্রামে বাস করে। একটি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভাগওয়ারি অকৃষি খাতে জমি চলে যাওয়ার প্রবণতা চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি। এখানে প্রতি বছর ১৭ হাজার ৯৬৮ হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ১৫ হাজার ৯৪৫, ঢাকায় ১৫ হাজার ১৩১, খুলনায় ১১ হাজার ৯৬, রংপুরে ৮ হাজার ৭৮১, বরিশালে ৬ হাজার ৬৬১ হেক্টর প্রতি বছর অকৃষি জমিতে পরিণত হচ্ছে।