ফি বাড়ানোর খবর রাখেনি সরকার : শেষ মুহূর্তে বিপদে ৪৫ হাজার হজযাত্রী

স্টাফ রিপোর্টার: গত বছরের ৭ আগস্ট দেশের নতুন ভিসা কাঠামো অনুমোদন করে সৌদি আরব মন্ত্রিপরিষদ, যা কার্যকর হয় ২ অক্টোবর (১ মহররম)। নতুন নিয়মাবলিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, পুনরায় হজে গেলে দুই হাজার রিয়াল ফি দিতে হবে। তবে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের জারি করা বিশাল হজ প্যাকেজের কোথাও এর উল্লেখ ছিলো না। এরই পরিণতি ৪৫ হাজারের মতো হজযাত্রীর ফ্লাইট নিয়ে অনিশ্চয়তা। সংশ্লিষ্ট অনেকেই এখন এ জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ আনছে। বিমানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন বিমান খালি যাচ্ছে। যাত্রী সংকটের কারণে অনেক সৌদি ফ্লাইট বাতিল করতে হচ্ছে। এমনকি সৌদি এয়ারলাইনসের ফ্লাইট পর্যন্ত যাত্রীশূন্যতার কারণে বাতিল করতে হয়েছে। এটা রীতিমতো নজিরবিহীন। এ জন্য বড় খেসারত দিতে হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ বিমানের নির্ধারিত স্লট বরাদ্দ রয়েছে। সেটা শেষ হয়ে গেলে নতুন করে স্লট নিতে সমস্যায় পড়তে হবে। তা ছাড়া হজ পালনের নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে রাখা হয়। শুধু বাংলাদেশিদের জন্য তো আর হজের আনুষ্ঠানিকতা পিছিয়ে দেয়া হবে না। হজ এজেন্সি মালিকদের সংগঠন হাবের নেতারা বলছেন, এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ শাখা থেকে ১০ পৃষ্ঠার একটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করলেও নতুন ভিসা ফি নিয়ে তাতে কিছু বলা হয়নি। এ কারণে প্রায় ২০ হাজার হজযাত্রী যারা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার হজ করতে যাচ্ছে তাদের সঙ্গে হজ এজেন্সিগুলোর দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়েছে। মুয়াল্লিম ফি বৃদ্ধিও সমস্যাকে জটিল করেছে। হজ প্যাকেজ ঘোষণার পরই দেশের সব হজ এজেন্সির মালিকরা হজযাত্রীদের সঙ্গে আর্থিক চুক্তি সম্পন্ন করেন। চুক্তির পর কেউ অতিরিক্ত টাকা দাবি করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় না। গত বছরের আগস্টে নতুন ভিসা কাঠামো অনুমোদন ও হিজরি মাসের প্রথম দিন থেকে তা কার্যকর করার অনেক সংবাদ প্রতিবেদন সৌদি আরবের সব গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক অনেক মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে। তাই বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট অনেকেই যে ‘নতুন ফি’ বলে দাবি করছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল জলিল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে জানতাম না। গণমাধ্যমের খবর, তারা যদি এখনকার সিদ্ধান্ত আগের বলে চালিয়ে দিতে চায় তবে তো আমাদের কিছু করার নেই। ’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগে জানলে দুই হাজার রিয়ালের বিষয়টি প্যাকেজে যুক্ত করতাম।

ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেছেন, ‘সমস্যা সমাধানে আগামীকাল (আজ) মন্ত্রণালয়ে সভা ডাকা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন নিজেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দ্রুত এসব জটিলতা নিরসন না হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার যাত্রীর হজ করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। গতকাল এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত বাংলাদেশি ৫১৯টি হজ এজেন্সির পাঠানো ২৮ হাজার হজযাত্রীর কাছ থেকে মোয়াল্লেম ফি এবং অতিরিক্ত ভিসা ফি আদায় করা হয়েছে বলে হাব সূত্রে জানা গেছে। এ টাকা না পাওয়া পর্যন্ত যাত্রীদের সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের দেশে ঢুকতে দিচ্ছিল না। ফলে এ টাকা সংগ্রহ করে ওদের নিজস্ব স্থানে নিরাপদে নিয়ে যাওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। কারণ, অতিরিক্ত এ টাকার বিষয়ে এজেন্সিগুলো এবং হজ গমনেচ্ছুক কারোই পূর্ব ধারণা ছিল না। গতকাল সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক আন্ত মন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে হজে যাতায়াতের সমস্যা নিরসনের জন্য এখন থেকে নিয়মিত (শিডিউল) ফ্লাইটেও হজযাত্রীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সব হজযাত্রীকে খুদে বার্তার মাধ্যমে ভিসা না করে থাকলে ভিসা করা এবং করে থাকলে ফ্লাইট ধরার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে বলে সভায় জানানো হয়। সভা শেষে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সভার সিদ্ধান্ত জানান। সভায় বিমানমন্ত্রী এবারের সংকটের কথা তুলে ধরে বলেন, এবারে মূলত মোয়াল্লেম ফি বৃদ্ধি করা এবং পুনরায় যাঁরা হজে যাচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দুই হাজার রিয়াল ধার্য করার কারণেই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মন্ত্রী সভার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, নিয়মিত ফ্লাইটে অন্য যাত্রী বাদ দিয়ে হজযাত্রীদের বহন করা হবে। এ ছাড়া পথ খোলা নেই। মন্ত্রী বলেন, অতিরিক্ত দুই হাজার রিয়ালের বিষয়ে বুধবারই সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোর বৈঠক হওয়ার কথা। আলোচনার মাধ্যমে এ অর্থ মওকুফ করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। মন্ত্রী বলেন, ‘যদি দিতেই হয়, তাহলে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে সে অনুযায়ী একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হবে। তবে মোয়াল্লেম ফি নিয়ে দেখা দেওয়া সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে বলে মন্ত্রী ভরসা দেন। তিনি বলেন, ৯১টি এজেন্সির ক্ষেত্রে এই সমস্যা ছিল। আশা করা যাচ্ছে, আজকের (বুধবার) মধ্যে তারা এ বিষয়ে ‘বারকোড’ পেয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘জটিলতা হলেও আশা করছি এ সমস্যা থেকে উত্তরণ পাওয়া যাবে। হাবের অর্থসচিব মাওলানা ফজলুর রহমান গতকাল রাতে জানান, ইতোমধ্যেই যাঁরা সৌদি আরবে পৌঁছে গেছেন তাদের মধ্যে পুরনো হাজিরা সমস্যায় পড়েছেন। ২৪ জুলাই হজ ফ্লাইট যখন শুরু হয়, তখনও সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ের সফটওয়্যারে দুই হাজার রিয়ালের বিষয়টি ঢোকানো সম্পন্ন হয়নি। সম্ভবত ২৭ তারিখ তাদের সার্ভার পুরো সক্রিয় হয় এবং চলে যাওয়া হাজিদের মধ্যে যাঁরা নতুন শর্তের আওতায় পড়ছেন তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। গতকাল আশকোনার হজ ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, অনেক হজযাত্রীর মনে এবার হজ করতে পারা নিয়েই আতঙ্ক কাজ করছে।

দিনাজপুর শহরের বাসিন্দা হজযাত্রী হাফিজুর রহমান আশকোনা হজ ক্যাম্পে গত মাসের ২৯ তারিখ থেকে ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে দুবার সময় নির্ধারণের পরও তাঁর ফ্লাইট হয়নি। এবার বলা হচ্ছে ৫ তারিখ ফ্লাইট হবে। হজ করতে পারবেন কি না এ প্রশ্ন তাঁর মনে বারবার উঁকি দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরই হজ নিয়ে যা হচ্ছে সেটা সত্যিই লজ্জার। এ দেশে সব কিছুই সম্ভব। আশঙ্কা হচ্ছে, এবার সত্যি সত্যি হজব্রত পালন করতে পারব কি না। আল আমানাহ হজ এজেন্সির কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘পুরনোদের দুই হাজার রিয়াল করে ভিসা ফি দেওয়ার শর্ত এবং মুয়াল্লিম ফি ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বাড়ানোর তথ্যটি আমরা জানতে পারছি সৌদি আরব গিয়ে। অথচ এ খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি প্রায় এক বছর আগে সৌদি সরকার নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানায়নি। মন্ত্রণালয়ের দেয়া হজ প্যাকেজে নতুন ফির উল্লেখ না থাকার বিষয়ে হাবের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন তসলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হজ গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে হলে সেটা হজ প্যাকেজে উল্লেখ থাকতে হয়। তা ছাড়া অতিরিক্ত টাকাটা তো সামান্য নয় যে আমরা নিজের পকেট থেকে এখন দিয়ে দেবো।

গতকাল বুধবার রাজধানীর আশকোনায় হজ অফিসে গিয়ে জানা যায়, ২৪ জুলাই থেকে হজ ফ্লাইট শুরু হলেও হজ এজেন্সিগুলোর কোনো তত্পরতা নেই। তারা হজ ক্যাম্পে হজযাত্রীদের হাজির করছে না। ফলে একটার পর একটা ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। অনেক হজ এজেন্সির মালিক এখনো সৌদি আরব অবস্থান করছেন বলেও জানা যায়। হাবের একাধিক সদস্য ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দিনের পর দিন হজ পালনের বিষয়টি জটিল করা হচ্ছে। আগে মুয়াল্লিমের কোনো অভাব ছিল না। এবার সৌদিতে গিয়ে মুয়াল্লিম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যার অজুহাতে মুয়াল্লিম ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের দাবি, গত ২৯ জানুয়ারি সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি হলেও দেশটি অতিরিক্ত দুই হাজার রিয়ালের কোনো নির্দেশনা দেয়নি। এ কারণেই তা হজ প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, মঙ্গলবার রাতে সৌদি আরবে হজ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে বাংলাদেশ হজ মিশনের সাক্ষাতের কথা ছিল। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। তবে বুধবার রাতে পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের প্রতিনিধিদের সৌদিতে এ বিষয়ে বৈঠকের কথা রয়েছে বলেও সূত্র দাবি করছে।

আশকোনা হজ ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, ই-ভিসা জটিলতার কারণে কনফার্ম থাকার পরও যাত্রীরা বিমানে উঠতে পারছেন না। মোহাম্মদ ইয়ার নামের এক হাজি বলেন, বুধবার বিকেল ৫টায় সাউদিয়া এয়ারলাইনসের এসভি-৮০৭ ফ্লাইটে স্ত্রী জীবন নিসাকে নিয়ে বিমানে ওঠার কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে বলা হয়, এখনো ভিসা হয়নি। আপনারা ফ্লাই করতে পারবেন না। ‘আবার কবে ফ্লাইট কনফার্ম করা হবে— সেটিও নিশ্চিত করতে পারেননি মুয়াল্লিম’ অভিযোগ করেন তিনি। এমন অসংখ্য হজযাত্রী ই-ভিসাসংক্রান্ত জটিলতায় প্রতিদিন নিরাশ হয়ে ফিরছেন।