প্রস্তুতি শেষ কাল নির্বাচন : জেলা ভোটে টাকার উত্তাপ

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাত পোয়ালেই জেলা পরিষদ নির্বাচন। আর এই নির্বাচনকে ঘিরে চলছে টাকার খেলা। প্রার্থীরা শুধু ভোট প্রার্থনাই নয়, ভোটের দাম নিয়েও দর কষাকষি করছেন ভোটারদের সাথে। তাই এই নির্বাচনে উত্তেজনা না থাকলেও টাকার উত্তাপ ঠিকই টের পাচ্ছেন প্রার্থী ও ভোটাররা। বিএনপি-জাতীয় পার্টি অংশ না নেয়া, ভোটারদের অনাগ্রহ সর্বোপরি ভোটের মাঠে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অনেকটাই খেই হারিয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচন। আবার বিনা প্রতিযোগিতায় এক-তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান ও শতাধিক সংরক্ষিত ও সদস্য প্রার্থীর জয় লাভের বিষয়টিও ‘নির্বাচনী আমেজ হারানোয় প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, যে নির্বাচনের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা নেই, সেই নির্বাচনে উৎসবের আমেজ থাকবে না_এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নেই, তাই তারা ছাড়া অন্য কারোর আগ্রহ থাকার কথাও নয়।

এ ব্যাপারে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা প্রহসনের নির্বাচন, একতরফা নির্বাচন। আওয়ামী লীগ যাকে চাইবে, তিনিই জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হবেন। যেহেতু বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি আওয়ামী লীগের, তাই তাদের প্রার্থীরই জয় নিশ্চিত। তাই নির্বাচন নিয়ে কারোর আগ্রহ নেই। সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান ইতোমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ৫ জানুয়ারির আদলে নির্বাচিত এই চেয়ারম্যানের সংখ্যা ২২ জন। ফলে বুধবার অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ৬১ জেলার মধ্যে ৩৯টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের আগেই ২২টি জেলায় নির্বাচনী আমেজ শেষ হয়ে গেছে। আবার পাঁচটি জেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে স্বতন্ত্র বা তুলনামূলক কম জনপ্রিয় দলের প্রার্থীরা লড়াই করবেন। যেখানে ওইসব দল থেকে প্রার্থীদের জেতার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই ওইসব জেলাতেও নির্বাচনী খরা বইছে। বাকি থাকা ৩৪ জেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। সেসব জেলায় কিছুটা নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করলেও সেখানে হচ্ছে মূলত টাকার খেলা।

জানা গেছে, এসব জেলার প্রতিটি ভোটের দাম এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাধর ভোটার হিসেবে তার দাম ১০ লাখ টাকাও উঠেছে। অনেক প্রার্থী ইতোমধ্যে ভোট কিনেও ফেলেছেন। সর্বশেষ যারা ভোট বিক্রি করছেন তাদের অনেকের সাথে দর- কষাকষি হচ্ছে। সূত্র জানায়, যেহেতু প্রার্থীরা মোটা অংকের টাকা দিয়ে ভোট কিনে নিচ্ছেন তাই সংশ্লিষ্ট ভোটার ভোট দিয়েছেন কি-না তার প্রমাণ রাখার নিশ্চয়তা চাচ্ছেন প্রার্থীরা। সেক্ষেত্রে ভোটাররাও নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। সারাদেশেই ভোট কেনাবেচার খবর পাওয়া গেলেও এ বিষয়টি কোনো প্রার্থী বা ভোটার স্বীকার করেননি। সম্প্রতি বগুড়া জেলার ধুনট, শেরপুর, কাহালু ও দুপচাঁচিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, ভোটারদের ভোট কেনা ছাড়াও বিভিন্ন উপহার দেয়া হচ্ছে। উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা চেয়ারম্যানরাও অনেকেই অন্য ভোটারদের দায়িত্ব নিয়ে ভোট কিনছেন। কোনো ভোটার বেঁকে বসলে তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়ার জন্যও স্থানীয় এমপি, উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যানরা ভোটারদের চাপ সৃষ্টি করছেন। তারা বলছেন, সরকার মনোনীত প্রার্থীকে ভোট না দিলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হবে। সিরাজগঞ্জে দল মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য দল থেকে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মানিকগঞ্জেও প্রার্থীরা ভোটারদের মধ্যে টাকা-পয়সা লেনদেন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এখানকার বিদ্রোহী প্রার্থী মো. রমজান আলী রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী টাকা দিয়ে ভোট কিনছেন। এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন। এখানে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। এমনকি ভোট কেনাবেচার সাথেও তারা জড়িত বলে অনেকে বলেছেন। অনেক ভোটার তাদের টাকা-পয়সা পেয়েছেন বলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন। পিরোজপুরের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ শাহ আলম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিদ্রোহী প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজ পরস্পরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন, ভোটারদের লোভনীয় অফার ও অর্থ লেনদেন করছেন। ভোট কেনাবেচার একই অভিযোগ উঠেছে দেশের একেবারে দক্ষিণে সুন্দরবন ও সীমান্তঘেঁষা জেলা সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ নির্বাচনে। এখানে দলীয় সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে জিততে ব্যাপক টাকা ছড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন এ জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মনসুর আহমেদ।

এদিকে সিলেট জেলা পরিষদ নির্বাচনেও চলছে ব্যাপক হারে ভোট কেনাবেচার লড়াই। এ জেলা পরিষদে মোট ভোটার এক হাজার ৪৯৩ জন। এখানে ২১টি পদের বিপরীতে চেয়ারম্যান পদে চারজন এবং বাকি ২০ পদে ১৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সিলেট জেলা পরিষদের ভোটার হচ্ছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ৩৭ জন, জেলার ১০৫ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ এক হাজার ৩৬৫ জন, ১৩ উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানসহ ৩৯ জন ও ৪ পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলরসহ ৫২ জন। এ নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক ভোটার (মেম্বার) জানান, বিভিন্ন প্রার্থী টাকার অফার দিচ্ছেন। কেউ নিচ্ছেন, কেউ ভাবছেন। কেউ দর-কষাকষিতে রয়েছেন একাধিক প্রার্থীর সাথে। তারা জানান, যেভাবে প্রচারণা চলছে, নির্বাচনের দুই দিন আগে টাকার বস্তা নিয়ে প্রার্থীরা ছুটবেন ভোটারদের কাছে। এ ক্ষেত্রেও অনেক ভোটার ও প্রার্থী সতর্ক। তারা নিজেরা আর্থিক লেনদেন থেকে বিরত থাকছেন। ভোট কেনাবেচায় প্রার্থী ও ভোটারের বিশ্বস্তদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

আবার ঢাকা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইতোমধ্যে জিতে গেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, তার জেলা পরিষদে মেম্বার পদের জন্য ভোট কেনাবেচার কোনো খবর তিনি জানেন না। তবে এ উপজেলার বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এ জেলা পরিষদে চলছে ভোট কেনাবেচা। সাভার উপজেলার সব কটি ওয়ার্ডে একাধিক আওয়ামী লীগ প্রার্থী রয়েছেন। যার মধ্যে অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক। তারা জেতার জন্য টাকা ওড়াচ্ছেন। এ নিয়ে একই দলের মধ্যে বিভক্তি শুরু হয়েছে। ধামরাই, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, দোহারসহ সব উপজেলায়ও ভোট কেনাবেচার চিত্র একই বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে চেয়ারম্যান পদের পাশাপাশি শতাধিক ওয়ার্ডেও সংরক্ষিত সদস্য ও সাধারণ সদস্য পদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে ভোলায় চেয়ারম্যান, পাঁটি সংরক্ষিত সদস্য ও ১৫টি সাধারণ সদস্য পদের সব কটিতে একক প্রার্থী থাকায় সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে ওই জেলায় ভোট গ্রহণ হবে না। এছাড়া পাবনা, চাঁপাইনবাগঞ্জ, মাদারীপুর, পিরোজপুর, মেহেরপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও নরসীংদিসহ অধিকাংশ বিভাগে অনেক প্রার্থীই সংরক্ষিত সদস্য ও সাধারণ সদস্য পদে দাঁড়ানো প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় এসব জেলার কোনো কোনো সদস্য প্রার্থী ও তার সমর্থকরা নির্ঘুম প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ দল অংশ না নেয়ায় জেলা পরিষদ নির্বাচন একতরফা হচ্ছে। তাই এ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা সাধারণ মানুষ- কারোই আগ্রহ নেই। তথ্যমতে, পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিটি জেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সাধারণ সদস্য ও পাঁচজন নারী (সংরক্ষিত আসন) সদস্য নির্বাচিত হবেন। বিধিমতে, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জেলা পরিষদের ভোটার হবেন। এ হিসাবে স্থানীয় সরকারের চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬৫ হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে এই নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার রয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদে।

সূত্র জানায়, স্থানীয় পর্যায়ের এই নির্বাচনকে সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী দাবি করে বিএনপি অনেক আগেই নির্বাচন বর্জন ঘোষণা দিয়েছে। সে সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান অনুযায়ী এসব পদ প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। কিন্তু এখানে সেটা হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, সরকার দল জোরজবরদস্তি করে জেলা পরিষদের সব ভোটারকে নিজেদের করে নিয়েছে। কাজেই এখানে নির্বাচন করে কোনো ফল আসবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের ভোটার তথা অধিকাংশ ইউনিয়ন, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় ক্ষমতাসীনরা পদে আছেন বলে জাতীয় পার্টিও এই ভোটকে মূল্যহীন মনে করছে। আর সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম পরোক্ষ ভোটে অনুষ্ঠেয় জেলা পরিষদ নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের অংশ। স্থানীয় সংস্থা হিসেবে তৃণমূলের জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য জেলা পরিষদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। জনগণের সরাসরি প্রত্যক্ষ ভোটেই জেলা পরিষদ নির্বাচন হওয়া বাঞ্ছনীয়।

উল্লেখ্য, তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন কাল সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ করবে। যেখানে চেয়ারম্যান পদে মোট ১৯০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আর সংরক্ষিত সদস্য পদে ৮৯৫ এবং সাধারণ সদস্য পদে লড়বেন তিন হাজার ৫৬১ জন প্রার্থী। এর আগে নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীরা ১ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেন। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হয় ৩ ও ৪ ডিসেম্বর। আর প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয় ১২ ডিসেম্বর। ২০ নভেম্বর পার্বত্য তিন জেলা বাদে ৬১ জেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।