প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মানব জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারকবাহক

চুয়াডাঙ্গার কালুপোল প্রত্নতাত্ত্বিক রাজারভিটা খনন ও উন্মুক্ত প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বেগমপুর প্রতিনিধি: বাংলাদেশ অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ঐতিহ্যের অধিকারী। আর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে মানব জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারকবাহক। আড়াই হাজার বছরের অধিক সময়ে এদেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, শাসক শ্রেণি গড়ে তোলেন অসংখ্য ইমারত, নগর, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার স্তম্ভ ও সমাধি সৌধ। এসব ঐতিহ্যের অধিকাংশই কালের গর্ভে বিলীন হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংস্কৃতি চিহ্ন এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজো টিকে আছে। যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। এসব প্রত্ননিদর্শনের অনুসন্ধান, খনন, সংরক্ষণ, প্রদর্শন এবং গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাস পুনরুদ্ধারে কাজ করে থাকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। এটি তারই একটি অংশ।
গতকাল শনিবার বেলা ১১টায় চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের কালুপোল প্রত্নতাত্ত্বিক রাজারভিটা খনন ও উন্মুক্ত প্রদর্শনী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে পুরোনো বা প্রাচীন স্থাপত্য ও শিল্পকর্ম, মূর্তি, ভাস্কর্য, অলঙ্কার, প্রাচীন আমলের মুদ্রা, বা মূল্যবান আসবাবপত্র। যা প্রাচীনকালের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থা, জীবনযাত্রা, সংস্কার, রুচি বা দৃষ্টি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে। এসব মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার হলে জেলার আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। যার সুফল ভোগ করবেন জেলাবাসী। যতটুকু জেনেছি বিভিন্ন সময় জরিপের কাজ করা হলেও তা থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা বাদ পড়ে গেছে। যার কারণে এ জেলার প্রাচীন ইতিহাস সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি। দেরিতে হলেও তা আজ উন্মুক্ত হতে চলেছে। খুলনা আঞ্চলিক প্রতœতাত্ত্বিক অধিদফতরের আয়োজনে অনুষ্ঠিত খনন ও উন্মুক্ত প্রদর্শনী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওয়াশীমুল বারী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল ইসলাম, পল্লী বিদ্যুত সমিতির চেয়ারম্যান আকরামুল হক বিশ্বাস খোকন, তিতুদহ ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা আ.লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান টিপু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইউপি সদস্য মজিবর রহমান। খুলনা প্রতœতাত্ত্বিক অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতার পরিচালনায় আরও উপস্থিত ছিলেন সহকারী পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান, কাস্টোডিয়ান মহিদুল ইসলাম, সিনিয়র ড্রাফটসম্যান জাহানদার আলী, বিভাগীয় ফটোগ্রাফার আব্দুস সামাদ, ইউপি সদস্য জাকির হোসেন, মজিবার রহমান, বরকত আলী, রবিউল ইসলাম রুনু, আবদার হোসেন, রহিম, মিনাজ উদ্দীন, আলী হোসেন, আসাদুল হক, মাইনদ্দীন, নজরুল ইসলাম, মেহের আলী, ছমির উদ্দীন, আব্দুর রাজ্জাক, বাবলু ফকির, মান্নাল প্রমুখ।
উল্লেখ্য, ইতিহাস সমৃদ্ধ চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কারে জরিপ শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদফতর। এ জরিপে চুয়াডাঙ্গা জেলার ২২৫ গ্রামের ১০৪ জায়গায় অনুসন্ধান চালানো হয়। এর মধ্যে পুরাকীর্তি ১৬, আবাসিক ২১, মসজিদ ১৯, মাজার বা পাবলিক সমাধি ১৯, নীলকুঠি ৬, মন্দির ৫, প্রাচীন জলাশয় ৪, অফিস ৪, রেলস্টেশন ৪, স্কুল ৩, প্রত্নতত্ত্ব ঢিবি ৩, তফশিল অফিস ২, রেলসেতু ২, প্রাচীন কবর ২, গীর্জা ১, পার্ক ১, শিল্পস্থাপনা ১, বিশ্রামাগার ১ ও ১টি তোরণ রয়েছে। আর এসব স্থাপনা চুয়াডাঙ্গা সদরে রয়েছে ৫৯, জীবননগর উপজেলায় ১৫, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২১ ও দামুড়হুদা উপজেলায় ৯টি। এর মধ্যে ২টি স্থানকে চিহ্নিত করে খননের কাজ চলছে। তার মধ্যে রয়েছে দামুড়হুদার চারুলিয়া মেহমান শাহ’র মাজার সংলগ্ন ঢিবি এবং চুয়াডাঙ্গা সদরের কালুপোল গন্ধর্প রায়ের রাজার ভিটা। শুরুতেই কালুপোল গন্ধর্প রায় রাজার (রাজার ভিটা) প্রাসাদে প্রাথমিক খনন কাজ করতে গিয়ে বেশকিছু প্রাচীন নিদর্শনের নমুনা আবিষ্কার হয়েছে। ঘোষণা ছিলো স্থানটিকে সংরক্ষণ পুরাকীর্তি স্থান ঘোষণা করতে পারলেই মূলকাজ শুরু হবে। এটি তারই অংশ। আর এ ভিটা থেকে যে সমস্ত নিদর্শন পাওয়া যাবে তা সংরক্ষণ করে রাখার জন্য প্রয়োজন হবে জাদুঘরের। ইতোমধ্যেই জাদুঘর নির্মাণের জন্য এলাকার ২০জন জমি দান করেছেন এরই মধ্যে রাজার ভিটা এবং চারুলিয়া ঢিবি খনন করে বেশকিছু প্রাচীন পুরাকীর্তি পাওয়া গেছে। তার মধ্যে আছে ধুপচি, লোহার তৈরি বল্লম, মাটির হাড়ি, সরা, কড়ি, পশুর হাড়, হরিণের শিং, মাটির তৈরি পুতুল, প্রদীপ, সানকিসহ নতুন নতুন অনেক কিছু। আলোচনার পূর্বে প্রধান অতিথি জিয়াউদ্দীন আহমেদ রাজার ভিটা এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের প্রদর্শিত গ্যালারি ঘুরে দেখেন এবং এটাকে সমৃদ্ধ করার সকল প্রতিশ্রুতি দেন।
এদিকে তিতুদহ ইউপি চেয়ারম্যান আকতার হোসেন বলেন, রাজার ভিটাটি ১৯৬২ সালে গ্রামের মৃত গোলাম রহমানের ছেলে মধু বিশ্বাসের নামে রেকর্ড হয়ে মালিকানাধীন হয়ে যায়। বর্তমানে মধু বিশ্বাসের ওয়ারেশ গোলাম মোস্তাফা এ ভিটার দাবিদার। এসএ ১৪২০ দাগে ৮০ শতক এবং আরএস ২০৩৫ দাগে ৮১ শতক রেকর্ডভুক্ত হয়ে আছে। আর জাদুঘর করার জন্য এলাকার ২০জন জমিদাতা ২৭ শতক জমিদান করেছেন। যা প্রতিষ্ঠানের নামে রেজিস্ট্রি হয়ে খারিজ হয়ে গেছে।