প্রতিবার কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হয় তোড়জোড়

ট্রাকে তোলা হচ্ছে গরু : গৃহিণী ঝরাছেন অশ্রু

 

কামরুজ্জামান বেল্টু/শান্ত আহম্মেদ: বাড়ির সামনের রাস্তায় ট্রাকে তোলা হচ্ছে গরু। তদারক করছেন গৃহকর্তা। আর রান্নাঘরের পাশে গোলার আড়ালে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছেন গৃহিণী। প্রতিবারই কোরবানির সময় গরু বিক্রির মরসুম শুরু হলেই চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও কুষ্টিয়াসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রায় অধিকাংশ কৃষক পরিবারেই এ দৃশ্য ফুটে ওঠে।

কোরবানির হাটে বিক্রি করতে পারলে একটু বেশি দাম পাওয়া যাবে। এ আশায় দিন কাটে গৃহকর্তা-গৃহিণীর। কিন্তু এবার সেই আশার গুঁড়ে যেন বালি। এলাকার হাটে গরু নিয়েও খরচ পোষানোর মতো দাম উঠছে না। তাইতো ঢাকায় নেয়ার কথা ভাবছেন কেউ কেউ। অবশ্য ক’দিন ধরে প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকেই মোটা তাজা করা গরু ট্রাকভর্তি করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন কৃষক ও গরুব্যাপারীরা। ঢাকার কোরবানির হাটগুলোতে বেচা বিক্রি তেমন না লাগার কারণে স্থান পাওয়া নিয়েও দুঃশ্চিন্তা কাটছে না ঢাকামুখি গরুর ব্যাপারীসহ গরু বিক্রির কৃষকদের। এলাকার হাটে দাম নেই, বাড়ি বাড়ি ঘুরে গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে ব্যাপারীরা গরু কিনে নিয়ে যেতো, এবার তাতেও যেন টান। ব্যাপারীদের প্রায় সকলেই বাকিতে গরু কিনে হাটে বিক্রি করে পরে টাকা পরিশোধের সুযোগ নিতে চাইছে। বাকিতে কারবার করতে রাজি নন অনেকে। যেমন বাকির চেয়ে নগদে চার হাজার টাকা কম মূল্যেই গরু বিক্রি করে দম ছেড়েছেন চুয়াডাঙ্গা হানুরবাড়াদির মালেক। তিনি বলেছেন, পাঁচ মাস আগে গরুটা কিনেছিলাম ৪৫ হাজার টাকায়। গত তিন মাস ধরে বাড়তি খরচ করে মোটাতাজা করে তুললাম। বাড়ি থেকে দাম উঠলো ৫৬ হাজার টাকা। ওই টাকায় গরু দিতে রাজি হতেই ব্যাপারী চাইলো- বাকি। বাকিতে দিয়ে যদি ফাকিতে পড়ি! মা অসুস্থ। চিকিৎসা করাতে হবে। তাই চার হাজার টাকা কম দামেই নগদে বিক্রি করে দিলাম। তাতে লোকসান হলো কিছু। একই গ্রামের মালিতা পরিবারের ছেলে সাইফুল দু বছর ধরে গরু পালছেন। বিক্রি করে পালসার মোটরসাইকেল কিনবেন। গতবার গরুটার দাম উঠেছিলো ৯০ হাজার টাকা। ওই টাকায় পোষাচ্ছে না দেখে ঢাকা থেকে ফিরিয়ে এনেছিলো। এক বছর ধরে গরুটার পেছনে খাটছে, খাওয়াচ্ছে। এবার দাম উঠেছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এতেও খুশি নন সাইফুল। তাইতে এবারও সে গরুটি গতকাল ঢাকায় নিয়েছে। দেখা যাক, ঢাকার হাটে সে চড়া দামে বিক্রি করতে পারে নাকি গতবরের মতো ঢাকার পথেই কোরবানির ঈদ করে গরু নিয়েই বাড়ি ফেরে? নাসির উদ্দীন বলেছে, গরু মোটাতাজা করে আগে লাভ হতো, গত দু বছর ধরে লাভের আশা করা যাচ্ছে না। কারণ খাবারের দাম বেশি। তিনি বলেছেন, ৪৬ হাজার টাকা দিয়ে ছয় মাস আগে গরু কিনলাম। প্রতিদিন প্রায় দেড়শ টাকা করে খাবার-দাবারের খরচ। সে হিসেবে ২৭ হাজার টাকা খরচ হলো। অথচ গরুর দাম ওঠছে এখন ৭০ হাজার টাকা। কী এমন খাওয়া দিয়েছেন যে প্রতিদিন দেড়শ খরচ? জবাবে তিনি বললেন, দু কেজি চালের ভাত, দু কেজি খুদ, ভুট্টার আটা, গুঁড়ো ও বিচুলিসহ কিছু ওষুধ। অভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে গরু মোটাতাজা করে এবার মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান হচ্ছে বলে দাবি করলেন শঙ্করচন্দ্র গ্রামের মিনারুল। তিনি বলেছেন, আমি তিনটি গরু মোটাতাজা করছি। ওতে যা খরচ তা উঠবে না। তাই ভাবছি আগামীতে আর এ কাজ হাত দেবো না।

প্রতিবছর কোরবানির সময় দেশে মোট কতোটি গরু কোরবানি দেয়া হয়? এর চুলচেরা পরিসংখ্যান দেশে না থাকলেও গতবছর ৫৬ লাখ কোরবানি দেয়া হয় বলে এক সংক্ষিপ্ত জরিপে জানানো হয়। এবার এর কিছুটা কম হবে বলে অনেকেরই ধারণা। সে হিসেবে অর্ধকোটির কম নয়। ইতোমধ্যেই মোটাতাজা করা গরুর মাংস মানুষের জন্য কতোটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ গোলাম হায়দার বলেছেন, গরু সঠিকভাবে যত্ন নিলে ক্ষতিকর ডেক্সমেটাসন জাতীয় ট্যাবলেট দিয়ে মোটাতাজা করা লাগে না। গরুর কৃমির ওষুধ দিয়ে ঠিকমতো খাবার দিলেও গরু যেভাবে মোটা হয় ভাতসহ কিছু ইনজেকশন দিয়েও খানেকটা সেরকমই ফল পাওয়া যায়। কিন্তু গরু মোটাতাজা করা খামারিসহ কৃষক পরিবারগুলো তা না করে গরু বিক্রির আগে ডেক্সমেটাসন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করে গরুর শরীরে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গরুর শরীরে ওষুধ প্রয়োগ হোক, আর না হোক, গৃহিণীকেই গরুর খাবার দিতে হয়। গা ধোয়াতে হয়। মশার কয়েলও জ্বালাতে হয় গৃহিণীকে। অতো ভালোবেসে যাকে মোটাতাজা করে তোলা, তাকে যখন বিক্রির জন্য তোলা হয় ট্রাকে, তখন গৃহিণী কীভাবে না কেঁদে পারে? তাই তো আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে নীরবেই ঝরান অশ্রু। কর্তা বকতে পারেন ভেবে আঁচল দিয়ে বার বার চোখ মুখ মুছে আড়াল করেন কষ্ট।

গরু মোটাতাজাকরণ নয়, ঘরের ঘরে গরু পালনের প্রবণতা যতো বৃদ্ধি করা যাবে, দেশে গরুর চাহিদা পূরণে ততোই সহায়ক হবে। তাছাড়া গরু পালনের খামারও গড়ে তোলার মধ্যদিয়ে অনেকেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। শুধু কোরবানির হাটের জন্য নয়, গরু পালন লাভজনক। অবশ্য ভারত থেকে গরু পাচার করে আনার অবাধ সুযোগের কারণে দেশে গরুর দাম এবার তুলনামূলকভাবে কম। স্থানীয় গরুব্যবসায়ীসহ সচেতন কৃষকরা এরকমই মন্তব্য করে বলেছেন, ঘরে ঘরে গরু মোটাতাজা করার রেওয়াজ ধরে রাখতে সরকারের নানামুখি উদ্যোগ দেয়া দরকার। তা না হলে এক সময় মাংসের জন্য বেধে যাবে হাওখাও।