প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই পরিকল্পিতভাবে স্ত্রীকে হত্যা : ঘাতক স্বামী গ্রেফতার

আলমডাঙ্গার কুমারী গ্রামে জমিজমা নিয়ে ২ মামা ও খালা-খালুর সাথে আসছিলো বাবলুর বিরোধ

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার কুমারী গ্রামে রহস্যজনকভাবে মারা যাওয়া গৃহবধূর মৃত্যুর রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য স্বামী বাবলু হক পরিকল্পিতভাবে স্ত্রী হাসনা বেগমকে হত্যা করেন। আটকের পর পুলিশের নিকট হত্যার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। জমি নিয়ে মামা ও খালা-খালুর সাথে বিরোধের জের ধরে তাদেরকে ফাঁসানোর জন্যই স্ত্রীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন বাবলু। রাতে স্বামী-স্ত্রী মিলনের সময় দু’হাতে গলাটিপে পৈশাচিকভাবে হাসনা বেগমকে হত্যা করেন বাবলু। পুলিশের পাতা ফাঁদে পা ফেললে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে আটক করে। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে স্ত্রী হত্যার স্বীকারোক্তি দেন।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সকালে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ কুমারী মিলপাড়ার হাসনা বেগমের লাশ উদ্ধার করে। তার রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে গ্রামে গুঞ্জন শুরু হলে পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করে। এ মৃত্যুর সাথে স্বামী বাবলু হকের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রথম থেকেই জোর সন্দেহ ছিলো পুলিশের। বিশেষ করে বাড়িতে বাবলুর অনুপস্থিতি, মোবাইলফোন মাঝে মাঝে খোলা রাখা, মাঝে মাঝে বন্ধ করে রাখা ও মৃত হাসনা বেগমের বড় মেয়ে আনেসা খাতুনের অসংলগ্ন কথাবার্তায় পুলিশের সন্দেহ ঘনীভূত হয়। তাই পুলিশ আনেসা খাতুনকে বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এক পর্যায়ে সে স্বীকার করে সব। আনেসা খাতুন জানায়, ঘটনার ২ দিন আগে তার বাপ বাবলু ঢাকা থেকে বাড়ি চলে এসে গোপনে ঘরের খাটের নিচে অবস্থান করতো। একদিন এভাবে কাটিয়ে পরের দিন প্রকাশ্যে বের হয়। ঘটনার রাতে স্কুলছাত্রী আনেসার মা হাসনা বেগম ও বাপ বাবলু একসাথে রাত্রিযাপন করেন। তার আগে বাবলু আবার ঢাকায় যাবে সেজন্য সকালের খাবার রুটি ও আলুভাজি রেডি করে রাখে হাসনা বেগম। রাত বেশ খানিকটা গভীর হলে মা-বাপের খাট থেকে মায়ের গোঙানির শব্দ শুনতে পায় সে। কিন্তু লজ্জায় মা-বাপের রুমের খাটের কাছে যেতে পারেনি আনেসা। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লে রাত ২টার দিকে পিতা বাবলু মেয়ে আনেসা খাতুনকে ঘুম থেকে ডেকে জানান তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন এবং তিনি যে ঢাকা থেকে বাড়ি এসেছিলেন তা যেন কেউ না জানে তা মেয়েকে শিখিয়ে যান। এমনকি পুলিশকেও নয় বলে সতর্ক করে দেন তিনি। আনেসা খাতুন সে সময় মাকে ডাকতে চাইলে বাবলু নিষেধ করে বলে তোর মা ঘুমোচ্ছে। ডাকার দরকার নেই। বাবলু বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে আনেসা খাতুন তার মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে গেলে দেখে সব শেষ। বেডে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন মা।
কিশোরী আনেসা খাতুনের মুখ থেকে এ ঘটনা জানতে পেরে পুলিশ ঘাতক স্বামী বাবলুকে আটক করতে ফাঁদ পাতে। পুলিশের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে আটক হন বাবলু। আলমডাঙ্গা থানার এসআই গিয়াস কুমারী গ্রাম থেকে বাবলুকে আটক করেন। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তিনি মুখ খুলতে শুরু করেন। তিনি জানান, রাতে স্বামী-স্ত্রীর মিলনের এক পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে তিনি স্ত্রীর (হাসনা বেগম) গলা দু’হাতে চেপে ধরেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার (হাসনা বেগমের) শ্বাস রোধে মৃত্যু ঘটে। তবে এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিলো না বলে প্রথমে দাবি করেন বাবলু। কেন তিনি ঘটনার ২ দিন আগে গোপনে বাড়িতে এসেছিলেন? কেনই বা খাটের নিচে গোপনে লুকিয়ে ছিলেন? পুলিশের এসব প্রশ্নের জবাব প্রথমে দিতে চাননি গ্রেফতারকৃত বাবলু। এড়িয়ে যেতে চাইলেই পুলিশের উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করতে বাধ্য হন বাবলু। দৈহিক মিলনের সময় পূর্বপরিকল্পিতভাবেই গলাটিপে স্ত্রীকে হত্যা করেন ঘাতক স্বামী বাবলু। এ হত্যাকা-ে নিজেকে সম্পৃক্ত করে পুলিশের নিকট দেয়া বাবলুর স্বীকারোক্তির পর রাতে চাঁদপুর জেলা থেকে আলমডাঙ্গা থানায় উপস্থিত হন নিহত গৃহবধূর ভাই খোরশেদ ঢালী। এ সংবাদ লেখাবধি গতরাতে তিনি বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় একটি হত্যামামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
উল্লেখ্য, আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী মিলপাড়ার বাবলু হক একই উপজেলার বাদেমাজু গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে। তার বাপ-মা ঢাকার সাভার এলাকায় বসবাস করলেও ১৬-১৭ বছর আগে বাবলু নানার গ্রাম কুমারীতে চলে আসেন। প্রায় ১৪ বছর আগে তিনি চাঁদপুর জেলার দক্ষিণ রঘুনাথপুরের ইদ্রিস ঢালীর মেয়ে হাসনা বেগমকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর কুমারী গ্রামে পৃথক বাড়ি নির্মাণ করে স্ত্রী ও ৩ সন্তান নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। স্ত্রী ৩ সন্তানের জননী হাসনা বেগম (৩২) গত বুধবার রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ১টার দিকে মেয়ে ৮ম শ্রেণির ছাত্রী আনেসা খাতুন মায়ের গোঙানি শব্দ শুনে জেগে ওঠে। এরপর মায়ের বিছানায় গিয়ে মাকে দেখতে পায় নাক মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হচ্ছে। তার কিছুক্ষণ পরই হাসনা বেগম মারা যান। সংবাদ পেয়ে থানা পুলিশ ভোরে লাশ উদ্ধার করে তা ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে প্রেরণ করে। ময়নাতদন্ত শেষে গতপরশু সন্ধ্যায় লাশ বাড়িতে পৌঁছুলে রাত ১০টায় গ্রামের গোরস্তানে দাফন করা হয়। গ্রামসূত্রে জানা গেছে, জমিজমা নিয়ে হাসনার স্বামী বাবলু হকের সাথে তার ২ মামা ও খালা নুরজাহান আর খালু নবীছদ্দিনের বিবাদ চলে আসছিলো। তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর জন্যই নিজের স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন বাবলু। কিন্তু পুলিশের দক্ষতার কারণে হত্যারহস্য উন্মোচিত হলো ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই।