প্রতিদিনই একটু একটু করে খোঁড়া হতো সুড়ঙ্গ

পরিকল্পনা হয় দু বছর আগে : ব্যাংক কর্মকর্তারাও জড়িত

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রতিদিনই একটু একটু করে খোঁড়া হতো সুড়ঙ্গ। মাটি ফেলা হতো পাশের একটি খালে। সারাদিন সুড়ঙ্গ খোঁড়া শেষে রাতে আরেক বাসায় গিয়ে ঘুমাতো হাবিব ওরফে সোহেল (৩৭)। শুক্রবার সেই সুড়ঙ্গ পথ পৌঁছে যায় ব্যাংকের ভল্ট রুমে। দেখে তো অবাক! টাকা একেবারে হাতের কাছে। ফিল্মি স্টাইলে নিয়ে যায় ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। চালের বস্তার ট্রাকে সেই টাকা নেয়া হয় ঢাকায়। অবশেষে পালাতে পারেনি সে। চুরির ৭২ ঘণ্টার মাথায় টাকাসহ ধরা পড়েছে সে। তার মুখ থেকেই এখন বেরিয়ে আসছে সুড়ঙ্গ কেটে টাকা চুরির রোমহর্ষক বর্ণনা।

কিশোরগঞ্জে ব্যাংক লুটের ঘটনা ঘটেছে এভাবেই। সাম্প্রতিক সময়ে সাড়া  জাগানো এ ঘটনার নায়ক সোহেল ব্যাংক লুটের আদ্যপান্ত বর্ণনা করেছে ৱ্যাবের কাছে। এতো টাকা পেয়ে নিজেকে টাকার কুমির ভেবে বসেছিলো সোহেল। যে ট্রাকে করে ঢাকায় আসে সে ট্রাকের হেলপারকে দিয়ে দেয় ৭ লাখ টাকা। দাতা হাতেম তাই সোহেলের শেষ রক্ষা হয়নি। গতকাল বিকালে ৱ্যাবের গোয়েন্দা শাখার দল শ্যামপুরের ভাড়া নেয়া বাসায় হানা দিয়ে ধরে ফেলে সোহেলকে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় ইদ্রিস নামে তার এক সহযোগীকেও। বাসার খাটের নিচে রাখা ৪টি বস্তায় ভরা টাকাও উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারের পর দুর্ধর্ষ কাহিনী নিজেই খুলে বলে সোহেল।

সন্ধ্যায় ৱ্যাব সদর দপ্তরে সোহেল ও তার সহযোগী ইদ্রিসকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। আশ্রয় দেয়ায় ইদ্রিসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে টাকা উদ্ধারের বর্ণনা করেন ৱ্যাবের ডিজি মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, গতকাল বিকালে ১৬ কোটি ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৬৪ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় হাবিব ওরফে সোহেল ও ইদ্রিস নামে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর শ্যামপুরের বালুর মাঠের ৯ নম্বর প্লটের তন্ময় ভিলা বাড়ির ছয় তলা থেকে তাদের গ্রেফতার করে ৱ্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট। তিনি বলেন, এ ঘটনার সাথে ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশের তথ্য পাওয়া গেছে। বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

দু বছর আগে করা হয় পরিকল্পনা: ব্যাংক লুটের জন্য পরিকল্পনা করা হয় দু বছর আগে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাংকের পাশের ওই বাড়িটি আড়াই হাজার টাকায় ভাড়া নেয় সোহেল। দিনের বেলা সে এই বাড়িতে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ করতো। রাতে গিয়ে পাশের নগুয়া এলাকায় স্ত্রীর সাথে থাকতো। সোহেল জানায়, ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা ছিলো তার মামাশ্বশুর সিরাজের। সে আগে ঢাকায় শাহীন ক্যাবলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো। ২০০৮ সালে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে সে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। ২০১১ সালে ফিরে আসে ঢাকায়। হাতে নিয়ে আসে ৭ লাখ টাকা। পাঁচ লাখ টাকা ধার নেয় মামাশ্বশুর সিরাজ। সেই টাকা চাইতে গেলে সিরাজই তাকে ব্যাংক লুটের পরিকল্পনার কথা বলে। ওই ব্যাংকে সিরাজের অ্যাকাউন্ট ছিলো বলে সোহেল জানায়। ব্যাংকে অনেক টাকা থাকতো বলে সিরাজ তাকে জানান।

যেভাবে খোঁড়া হয় সুড়ঙ্গ: ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সোহেল বলে, ২০১২ সালের প্রথম দিকে সে দু কক্ষের ওই বাসাটি ভাড়া নেয়। ভাড়া নেয়ার কিছুদিন পর থেকেই কক্ষের পাশে সুড়ঙ্গ খোঁড়া শুরু করে। এর আগে হ্যামার, ছেনি, কোদালসহ প্রয়োজনীয় সব উপকরণ কেনে। একই সাথে বাড়িতে জড়ো করা হয় কাঠ ও বাঁশ। সোহেল বলে, প্রতিদিন একটু একটু করে সুড়ঙ্গ খুঁড়তো। মাটি নিয়ে ফেলতো বাসার ভেতরেই একটি খালে। এছাড়া ঘরের এক পাশেও মাটি রাখা হতো। মাঝ খানে দু ভ্যান মাটি বাইরে নিয়ে ফেলা হয়। এতে পাশের বাড়ির মাওলানা আনোয়ার নামে এক ব্যক্তি সন্দেহ করে। পরে তার বাড়িতে কাজ হচ্ছে বলে বিষয়টি সামলে নেন। সোহেল জানান, মাঝে মধ্যে বাসায় তার মামাশ্বশুর সিরাজও গিয়ে তাকে কাজে সহযোগিতা করেছে। এছাড়া সুড়ঙ্গ পথে ওপরের মাটি আটকে রাখার জন্য কাঠ ও বাঁশ দিয়ে ঠেকা দিতো। এভাবে দু বছরে তিনি সুড়ঙ্গ খোঁড়া শেষ করেন।

ভুল পথে গিয়েছিল সুড়ঙ্গ: সোহেল জানায়, বাড়ি থেকে ব্যাংকের ভল্টের মাপজোক নিয়ে খোঁড়ার পরও সুড়ঙ্গটি অন্যদিকে চলে যায়। মাসখানেক আগে সুড়ঙ্গের মাথা ওপরে বের করে দেখেন সেটা ব্যাংকের বারান্দা। ওই বারান্দায় পুরোনো চেয়ার-টেবিল রাখা ছিলো। ফলে বিষয়টি কেউ টের পায়নি। পরে আবার মাপজোক নিয়ে নতুন পথে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সুড়ঙ্গ গিয়ে ঠেকে ব্যাংকের ভল্ট রুমে। এ সময় ওপরে একটি স্টিলের আলমারি ছিলো। সোহেল জানায়, জগ দিয়ে আলমারিটি সরানোর ব্যবস্থা করে। পরে শাবল দিয়ে ঠেলে ঠেলে কোনোমতে সে নিজে ভেতরে ঢুকে। এরপর নিজেই আলমারি সরিয়ে যাতায়াতের রাস্তা প্রশস্ত করে।

টেবিলেই পেয়ে যায় টাকা: সোহেল জানায়, তার ধারণা ছিলো ভল্ট রুমের আলমারি ভেঙে টাকা বের করতে হবে তাকে। কিন্তু ভল্ট রুমে ঢুকে টেবিলের ওপরই থরে থরে টাকা বিছিয়ে রাখা দেখতে পান। এতে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলো বলে মন্তব্য করেন। সোহেল জানায়, সুড়ঙ্গ দিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন নিয়ে ভেতরে লাইটও জালিয়েছিলো। ওই রুমের কোনো জানালা না থাকায় বাইরে থেকে সে আলো বোঝা যায়নি। রাত সাড়ে ৮টার দিকে ভল্ট রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। পরে ৭-৮টি প্লাস্টিকের বস্তা নিয়ে আবারো সুড়ঙ্গ পথে ভল্ট রুমে ঢোকেন। টাকাগুলো বস্তায় ভরে নিয়ে আসে নিজের বাসায়। রাত দুইটার দিকে সব টাকা নিয়ে নিজের বাসায় ফেরত আসে। পরে বাইরে থেকে আনা চটের বস্তায় ভরে টাকাগুলো। এক হাজার টাকার বান্ডিলগুলো দিয়ে তিনটি বস্তা ভরে ফেলে। পাঁচশ টাকার বান্ডিল হয় দু বস্তা। টাকা আলাদা করতেই করতেই তার সকাল হয়ে যায়।

চালের বস্তার ট্রাকে টাকা আনে ঢাকায়: সোহেল জানায়, সকালে তিন বস্তা টাকা নিয়ে একটি রিকশায় করে পাশের একটি চালের আড়তে যায়। চালের আড়ত ছিলো বন্ধ। রিকশা নিয়ে সকাল নয়টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলো আড়তের সামনে। পরে ওই আড়ত থেকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ২শ বস্তা চাল কেনে। ১২ হাজার টাকায় ঢাকা পর্যন্ত ঠিক করে একটি ট্রাক। শ্রমিকদের মাধ্যমে ওই চাল তোলে ট্রাকে। এর আগে দু ধাপে বাসা থেকে আনা টাকার বস্তাগুলো চালের বস্তার নিচে রাখে। নিজের কাছে রাখে ১৮-১৯ লাখ টাকা। গত শনিবার সকাল ১১টার দিকে চালের বস্তার সাথে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয় সোহেল। পথে নরসিংদীতে ট্রাকের চাকা পাংচার হয়। এ সময় ট্রাক হেল্পার সন্দেহ করে তার বস্তার ভেতরে অবৈধ কিছু আছে। গাঁজা ও ভারতীয় শাড়ি আছে বলে সন্দেহ করে হেলপার। একটি বস্তা সে নিজেই চায়। পরে সোহেল ওই হেল্পারকে ১৪টি ৫শ টাকার নোটের বান্ডিল দিয়ে তার মুখ বন্ধ করে।

চাল ফরিদপুরে, টাকা খাটের নিচে: সোহেল জানায়, ঢাকায় আনার পর শ্যামপুরে লাল মসজিদের পাশে ট্রাকটি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এ সময় সে হন্যে হয়ে বাসা খুঁজতে থাকে। আগে শাহীন ক্যাবলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুবাদে শ্যামপুরে থাকতো সোহেল। বালুর মাঠের পাশে তন্ময় ভিলায় সাড়ে ৮ হাজার টাকায় ষষ্ঠ তলায় একটি বাসা ভাড়া করে। পরে আরেকটি কাভার্ড ভ্যান ভাড়া করে চালগুলো পাঠিয়ে দেয় ফরিদপুরের এক ওরস শরীফে। টাকার পাঁচটি বস্তা ও ৮ বস্তা চাল নিয়ে যায় ওই বাসায়। ভ্যানচালক ও শ্রমিকদের দিয়ে চালগুলো ষষ্ঠ তলায় তোলে। এরপর ডেকে আনে এক সময়ের পুরোনো সহকর্মী ইদ্রিসকে। গত রোববার খাটসহ ঘরের প্রয়োজনীয় আরো কিছু জিনিসপত্র কিনে। খাটের নিচে লুকিয়ে রাখে টাকার বস্তাগুলো। ইদ্রিসকে বলে, এগুলো ইন্ডিয়ান শাড়ি। বস্তার ভেতরে বিশেষ কায়দায় লেপের কভার ও কম্বল দিয়ে রাখার কারণে বাইরে থেকে টাকার বিষয়টি বোঝারও কোনো উপায় নেই। নিশ্চিন্ত মনে ওই বাসাতেই অবস্থান করতে থাকে সোহেল।

যেভাবে গ্রেফতার সোহেল: ৱ্যাব কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক লুট হওয়ার পর থেকেই তারা গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করেন। তারা সুড়ঙ্গ খোঁড়া কক্ষের বাসিন্দা সোহেলের বিস্তারিত তথ্য উদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকেন। পরে এক পর্যায়ে তারা প্রযুক্তির সহায়তায় সোহেলের অবস্থান শনাক্ত করেন। থার্ড পার্টির মাধ্যমে সোহেলের ভাড়া নেয়া বাসাটিও চিহ্নিত করে ফেলেন ৱ্যাব কর্মকর্তারা। পরে গতকাল দুপুর ২টা থেকে শ্যামপুর এলাকায় অভিযান শুরু হয়। ৱ্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা ছদ্মবেশে শ্যামপুরে বালুর মাঠের ওই বাসার চার পাশে অবস্থান নেন। বিকেল ৩টার দিকে তারা ওই বাসার ভেতরে প্রবেশ করেন। এসময় ষষ্ঠ তলার বাসার ভেতরে সোহেল ও ইদ্রিসকে পেয়ে যান। পরে খাটের নিচে লুকানো অবস্থায় পাওয়া যায় পাঁচ বস্তা টাকা। টাকা উদ্ধার করে সহযোগীসহ সোহেলকে গ্রেফতার করে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ৱ্যাব সদর দপ্তরে। পরে সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে হাজির করা হয়।

ৱ্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ জানান, দুর্ধর্ষভাবে ব্যাংক লুট করলেও গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় তারা সোহেলকে ধরে ফেলেন। তবে তার মামাশ্বশুর সিরাজ পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। খুব শিগগিরই তাকেও গ্রেফতার করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃত সোহেলের বাড়ি পটুয়াখালীতে। তার বাবার নাম সিরাজউদ্দিন। কিশোরগঞ্জের সাদিয়া আক্তার নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলো। কয়েক মাস আগে স্ত্রী তাকে তালাক দিয়ে চলে গেছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।

গত শনিবার কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় প্রায় ১শ ফুট সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা লুট করে। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত রোববার ব্যাংকে গিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে টাকা লুটের বিষয়টি বুঝতে পারেন। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে পুলিশের আট সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ব্যাংকের ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও গ্রেফতার করা হয়।