পৌর নির্বাচনে দ্বিমুখি চ্যালেঞ্জে বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: আসন্ন পৌর নির্বাচন নিয়ে দ্বিমুখি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি। নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং না নেয়া-উভয় ক্ষেত্রেই দলটির জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে ভবিষ্যত লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ শুরু করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দলটির তৃণমূলসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই মনে করেন, দলীয় প্রতীকে হলেও পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত। ফাঁকা মাঠে সরকারকে গোল দিতে দেয়া ঠিক হবে না। অন্যদিকে আরেকটি অংশ মনে করছেন, এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগে ভবিষ্যত লাভ-ক্ষতি হিসাব কষেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তাদের মতে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার পেছনে সরকারের কোনো মতলব রয়েছে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিলে যে কোনো উপায়ে তারা ফল ছিনিয়ে নেবে। দেশে এবং বিদেশে প্রমাণ করতে চাইবে সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। তবে বিএনপির বড় একটি অংশ মনে করে, নির্বাচন বর্জন করা মোটেই ঠিক হবে না। নির্বাচনে অংশ নিলে জয়-পরাজয় যাই হোক না কেন, তাতে দলই লাভবান হবে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় এটাতে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ থাকবে। নির্বাচনে গেলেই কেবল এর বিরোধিতা করা যাবে। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এর বিরোধিতা করলে তা দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাছাড়া নির্বাচন বর্জন করা হলে তৃণমূলে হতাশা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও বিএনপির পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে দলের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, পৌর নির্বাচনের বিষয়ে এখনও আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। দলীয় ফোরামে একটা সিদ্ধান্ত হবে। আমি আশা করছি, আমাদের নেত্রী (খালেদা জিয়া) খুব শিগগির দেশে ফিরে আসবেন এবং এ বিষয়ে আমরা একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেব। খুব সম্ভবত আমরা নির্বাচনে যাব। ক্ষমতাসীনদের ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেয়ার প্রশ্নই আসে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, গত চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা অংশ নিয়েছি। এরপর ঢাকার দু সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। তাতে সরকারের ব্যবহার দেখেছি। সে ব্যবহার অব্যাহত থাকলে তা আমাদের প্রতিহত করতে হবে।
দলীয়সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রার্থী বাছাইয়ে বেশ বেগ পেতে হবে দলটিকে। দু দফা ব্যর্থ আন্দোলনের পর তৃণমূলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। সম্প্রতি সারাদেশে চলছে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানামুখি সমস্যায় তা এখনও শেষ হয়নি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব কোন্দল আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। বর্তমান বাস্তবতায় দলীয়ভাবে প্রার্থী চূড়ান্ত করা কঠিন হবে। কারণ, বেশিরভাগ পৌর এলাকাতে বর্তমানে দু-তিনটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় নিজ নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে তারা প্রস্তুতি শুরু করেছে।
সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি মামলা নিয়ে চিন্তিত তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তৃণমূলের প্রায় সব নেতার নামেই রয়েছে একাধিক মামলা। সম্প্রতি নতুন করে শুরু হয়েছে গ্রেফতার অভিযান। আগামী মাসে যেসব পৌরসভায় নির্বাচন হতে পারে এমন এলাকাকে টার্গেট করে গ্রেফতার অভিযান চলছে। গ্রেফতার এড়াতে নেতাকর্মীরা আবারও গা ঢাকা দিচ্ছেন। বলতে গেলে ধীরে ধীরে আবার মাঠ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই ও প্রচার চালাতে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়বে দলটি। এছাড়া নির্বাচনের দিন এজেন্ট নিয়োগও বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কারণ, বিগত তিন সিটি নির্বাচন নির্দলীয় হলেও বেশিরভাগ কেন্দ্রে তারা এজেন্ট দিতে পারেনি। মামলা এবং প্রশাসনের হুমকির কারণে দলের নেতাকর্মীদের অনেকেই এজেন্ট হতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। পৌর নির্বাচনে যেহেতু সরকার পরিবর্তন হবে না তাই কেউ ঝুঁকি নিয়ে এজেন্ট হবেন কি-না তা নিয়ে শংকা রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকা বিএনপির জন্য কঠিন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখি দল। তাদের নির্বাচনে আসা উচিত। দলের নেতারা সে রকম ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। তারা এলে নির্বাচনটা জমবে। তবে এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে নেতাকর্মীদের জন্য ভালো হবে। তারা প্রস্তুতি নেয়ার সময় পাবেন। তিনি বলেন, মামলা-হামলাসহ দলটির নানামুখি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু তাই বলে বসে থাকলে তো চলবে না। মাঠ ছেড়ে দিয়ে পালানোর চেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পরাজিত হওয়া ভালো। আর সরকার কোনো অনিয়ম করলে জনগণ তো দেখবে।
এদিকে ডিসেম্বরে পৌর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতারা নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে অনেকেই নির্বাচন করবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তারা কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন। শেষপর্যন্ত দলের হাইকমান্ড নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করা কতটা যৌক্তিক ছিলো তা আলোচনার দাবি রাখে। ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। পৌর নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ায় তা অনেকটা জাতীয় নির্বাচনের আমেজ থাকবে। তাই এ নির্বাচন বর্জন দলের জন্য আরও ক্ষতি বয়ে আনবে। কারণ, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আন্দোলন করায় মামলা-হামলায় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তছনছ হয়ে পড়ে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ না নিলে তৃণমূলের নেতৃত্বও এবার হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাদের হতাশা আরও বাড়বে। তাই তৃণমূল নেতাকর্মীদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের।
আসন্ন পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়ে রাজশাহীর বাগমারার তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা আ ন ম শামসুর রহমান মিন্টু জানান, কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। আশা করি, কেন্দ্র সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, কোনোমতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। কারণ, বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ চরম ক্ষুব্ধ। তারা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। তাছাড়া নির্বাচিত হলে জনগণের কাছাকাছি গিয়ে কাজ করারও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক জানান, পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার বিষয়ে দলের মধ্যে নানা মত রয়েছে। তবে অধিকাংশই মনে করছেন নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত। তাদের যুক্তি, কোনোমতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি প্রার্থীর জয়লাভ করার সম্ভাবনা বেশি। কারণ সরকারের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। তারা প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না। ব্যালটের মাধ্যমে তারা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাবেন। নির্বাচনে যে ক’টি পৌরসভায় বিএনপি প্রার্থী জয়ী হবেন, সেখানে সাধারণ মানুষের সাথে দলের একটি যোগসূত্র তৈরি হবে। কোনো অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচনে অংশ না নিলেও প্রথম দফায়ই দু শতাধিক পৌরসভার নেতৃত্ব হারাতে হবে। তাই তারা চাচ্ছেন না প্রথম এত সংখ্যক পৌরসভার কর্তৃত্ব হারাতে। দলের এ অংশটির মতে, নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়-পরাজয় যাই হোক উভয়েই বিএনপির লাভ হবে। সরকার যদি নির্লজ্জভাবে ব্যালট ছিনতাই করে তাদের প্রার্থীদের জয়ী করায়, তাহলে প্রমাণিত হবে, আওয়ামী লীগ ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তারা যে আন্দোলন করছে তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করা যাবে। তাছাড়া ফাঁকা মাঠে সরকারদলীয় প্রার্থীরা জয়লাভ করলে তাদের শক্তি আরও বাড়বে।
তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ মনে করছে, হঠাৎ করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার পেছনে সরকারের অন্য কোনো মোটিভ রয়েছে। বিশেষ করে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের প্রচার চালানোর সুযোগ দিয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি সংশোধনকে ভালো চোখে দেখছে না তারা। যে কোনোভাবে সরকারদলীয় প্রার্থীদের জয়লাভ করানোর লক্ষ্যেই আরচরণবিধিতে এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তাদের মতে, জাতীয় সংসদের কোনো আসনে উপনির্বাচনে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। অথচ দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনে তাদের কেন সেই সুযোগ দেয়া হচ্ছে। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা প্রচারে অংশ নিলে নিশ্চিতভাবে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। প্রশাসন নির্ভয়ে কাজ করতে সাহস পাবে না।
দলের এ অংশটির আশঙ্কা দলীয়ভাবে পৌর নির্বাচনে সরকার তাদের প্রার্থীদের জয়ী করতে প্রশাসনের ওপর নানা চাপ প্রয়োগ করবে। এমনকি মামলাসহ নানা কারণ দেখিয়ে বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল করা হতে পারে। যাতে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী থাকে। নির্বাচনে জয়লাভের পর তারা প্রচার চালাবে স্থানীয় নির্বাচনে তাদের (সরকার) প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। একই সাথে বিএনপিকে সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে এ অপপ্রচার চালাবে। তাই সরকারকে এ সুযোগ দেয়া ঠিক হবে কি-না তা ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করেন তারা। ওই অংশটির মতে, বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রায় সব কটিতেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে। কিন্তু সরকার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে তাদের বরখাস্ত করছে। তাই নির্বাচিত হলেও কোনো লাভ নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। চেয়ারপারসন আসার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তবে তৃণমূল নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। এর যথেষ্ট কারণও আছে। মফস্বলে রাজনৈতিক ময়দানে নেতাকর্মীদের অস্তিত্বের প্রমাণ হচ্ছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। তারা সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবে না। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বড় কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান দলটির এই নীতিনির্ধারক।
তিনি বলেন, তৃণমূলের চাপের পাশাপাশি সরকারের আচরণও দেখতে হবে। মামলা-হামলা ও নানা হয়রানির মাধ্যমে নেতাদের ঘরছাড়া করা হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ অনেককে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এটা তো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ইঙ্গিত বহন করে না।