পৌর দুটি পাম্পে না মিললেও পাবলিক ট্যাপসহ কয়েক গ্রাহকের বাড়ির পানিতে পাওয়া গেছে জীবাণু

 

চুয়াডাঙ্গায় আরো ৫ শিশুসহ শতাধিক ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি : রোগীর সংখ্যা হ্রাসে চিকিৎসকদের স্বস্তি

 

ড্রেনের সাথে টয়লেটের সংযোগ ১৪ আগস্টের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করার অনুরোধ : অন্যথায় সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা জরিমানা

স্টাফ রিপোর্টার: ডায়রিয়া আক্রান্ত আরো শতাধিক রোগী চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ৫ জন শিশুও রয়েছে। অপরদিকে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা কর্তৃক জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ঝিনাইদহস্থ আঞ্চলিক গবেষণাগারে প্রেরিত পানির পরীক্ষা রিপোর্ট পাওয়া গেছে। পৌর সরবরাহকৃত পানির দুটি উৎসস্থল তথা দু নম্বর ও দশ নম্বর পাম্পে ফেকাল কলিফর্ম পাওয়া যায়নি। তবে একামেডী মোড়স্থ পাবলিক ট্যাপসহ কয়েকজনের বাড়ি থেকে সংগ্রহকৃত পানিতে জীবাণুর অস্তিত্ব মিলেছে। পৌরসভার ড্রেনের সাথে যারা সরাসরি অবৈধভাবে টয়লেটের সংযোগ করেছেন তাদেরকে আগামী ১৪ আগস্টের মধ্যে তা বিছিন্ন করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্যথায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংযোগ প্রদানকারীদের সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা অথবা তদূর্ধ্ব জরিমানা আদায়সহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে রয়েছে, মাঝেপাড়ার ১১ জন, বাগানপাড়ার ১০ জন, মসজিদপাড়ার ৭ জন, জিনতলাপাড়ার ৮ জন, পোস্ট অফিসপাড়ার ৮ জন, আরামপাড়ার ৬ জন, মুক্তিপাড়ার ৬ জন ও পৌর এলাকার অন্যান্য পাড়ার ৩৭ জন। এছাড়া বিভিন্ন গ্রামের রয়েছে ২৩ জন। পূর্বের ভর্তিকৃত ডায়রিয়া রোগীদের অনেকেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ি ফিরলেও কয়েকজনকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তবে এ সংখ্যা গতকাল ছিলো হাতে গোনা কয়েকজন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর উপচেপড়া চাপ হ্রাস পেলেও ৬টি মেডিকেল টিম দায়িত্ব পালন করছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স, নার্সের পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে নেয়া সেবিকারা দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল হক প্রায় সার্বক্ষণিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম তদারকি করছেন। পাশাপাশি তদারকিতে রয়েছেন চুয়াডাঙ্গা বিএমএ সভাপতি মার্টিন হিরক চৌধুরী ও ঢাকার দুটি মেডিকেল টিম। ডায়রিয়ার প্রকোপ অল্প করে হলেও কমে আসায় চিকিৎসকদের মধ্যেই নেমে এসেছে স্বস্তি। স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক পানিসহ রোগীর ইস্টুল পরীক্ষা করতে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারে প্রেরণ করা হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রিপোর্ট চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছায়নি। সিভিল সার্জন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, আগামী রোববার নগদ রিপোর্ট আমরা হাতে পাবো বলে আশা করছি।

অপরদিকে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা কর্তৃক জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ঝিনাইদহ আঞ্চলিক গবেষণাকেন্দ্রে প্রেরিত পানি পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়া গেছে। এ রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পৌরসভা মেয়র এক বিবৃতিতে বলেছেন, পৌর সরবরাহকৃত পানির মাধ্যমে ডায়রিয়া বিস্তার ঘটেনি। চুয়াডাঙ্গা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী ওমর আলী বলেছেন, পৌর সরবরাহকৃত পানির দুটি উৎস স্থলে তথা পানির পাম্পে জীবাণু পাওয়া যায়নি। সরবরাহকৃত পানির ট্যাপে ও কয়েকজন গ্রাহকের বাড়ির পানিতে মলবাহী জীবাণুর অস্তিত পাওয়া গেছে।

পৌর মেয়র বিবৃতিতে বলেছেন, গত ১ আগস্ট ডায়রিয়া রোগের বিস্তার লাভ করায় জনমনে পৌরসভা কর্তৃক সরবরাহকৃত পানি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। আক্রান্ত এলাকার পাম্পের পানি এবং কয়েকটি আক্রান্ত বাড়ির পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়। পরীক্ষার প্রতিবেদন মোতাবেক পৌর সরবরাহকৃত পানি নিরাপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আক্রান্ত এলাকার পানির পাম্পসহ আরো একটি পাম্পের পানি পরীক্ষা করে তাতে কোনো জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে বাড়ি থেকে সংগৃহীত পানিতে সামান্য পরিমাণ ফেকাল-কলিফর্ম পাওয়া গেছে। এতে প্রতীয়মাণ হয় যে, গ্রাহকগণের রিজার্ভ ট্যাঙ্ক, ছাদের ওপরের ট্যাঙ্কে ও খাদ্য বিষক্রিয়ার জন্য ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে। তা ছাড়া তদন্তে দেখা গেছে আক্রান্ত এলাকায় অধিকাংশ বাড়ির টয়লেটের সংযোগ ড্রেনের সাথে সরাসরি দেয়া। ফলে ওই সমস্ত এলাকা অপরিচ্ছন্ন পারিবেশ ও খাদ্য বিষক্রিয়ার জন্য ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে। পৌরসভার পানির মাধ্যমে ডায়রিয়া বিস্তার ঘটেনি বলে পৌরসভার অভিমত। কাজেই পৌরসভার সরবরাকৃত সুপেয় পানির মাধ্যমে ডায়রিয়া বিস্তার লাভ করেছে মর্মে কতিপয় মিডিয়া ও পত্রিকার মাধ্যমে রটনাতে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। সেইসাথে ভবিষ্যতে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে গ্রাহকগণকে নিজ নিজ পানির রিজার্ভ ট্যাঙ্ক নিয়মিত ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার এবং হাউজ কানেকশনসমূহ ওয়াশ করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। এছাড়াও যে সকল ব্যক্তি অবৈধভাবে ড্রেনের সাথে সরাসরি টয়লেটে সংযোগ প্রদান করেছেন তাদেরকে আগামী ১৪ আগস্টের মধ্যে ওই সংযোগ বিছিন্ন করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। অন্যথায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংযোগ প্রদানকারীকে সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা অথা তদূর্ধ্ব জরিমানা আদায়সহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পৌরসভার ২নং ও ১০নং পানির পাম্পের পানি পরীক্ষা করে ফেকাল কলিফর্ম পাওয়া যায়নি। তবে একাডেমী মোড়ের পাবলিক ট্যাপে ফেকাল কলিফর্মের পরিমাণ পাওয়া গেছে ১৪। এছাড়া মাঝেরপাড়ার হুরমত আলীর বাড়ির পানিতে পাওয়া গেছে ১শ, বাগানপাড়ার শিউলী বেগমের বাড়ির পানিতে পাওয়া গেছে ২২, মসজিদপাড়ার মুক্তাদুর রহমানের বাড়ির পানিতে পাওয়া গেছে ১শ, আরামপাড়ার সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের বাড়ির পানিতে পাওয়া গেছে ৮০, পোস্ট অফিসপাড়ার হাজি রবিউল হকের বাড়ির পানিতে পাওয়া গেছে ৩০, মল্লিকপাড়ার জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ির পানিতে পাওয়া গেছে ৭০।

একই সাথে তামাম এলাকার বাড়ির পানিতে ফেকাল কলিফর্ম মিলতে শুরু করলো, আর একই সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকার নারী-পুরুষ কেন ডায়রিয়া আক্রান্ত হলো? এ প্রশ্নের জবাবে গতপরশু ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে আসা প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, পানির পাইপ কোথায় লিক রয়েছে। যেহেতু পানির পাইপ ও পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেনে বিভিন্ন স্থানে একই সাথে সেহেতু লিক দিয়ে জীবাণু পাইপে ঢুকেই বিপত্তি ঘটিয়েছে। গতকাল এ বিষয়ে অভিজ্ঞ বেশ কয়েকজন বলেছেন, পৌরসভার পানির পাম্পে জীবাণু থাকার কথা কেউ বলেনি। পরীক্ষা পাম্পের পানিতে তা পাওয়াও যায়নি। পৌর সরবরাহকৃত পানির গ্রাহকদের বাড়ির রিজার্ভ ট্যাঙ্ক বা ছাদের ওপরের ট্যাঙ্ক যদি পরিষ্কার না করার কারণেই জীবাণু জন্ম নেয়, তাহলে পৌরসভার ওই গণ ট্যাপের পানিতে এলো কোথা থেকে? নিশ্চয় পানি সরবরাহের পাইপেই কোথাও লিক রয়েছে। তা থেকেই ড্রেনের মল ঢুকছে পানিতে। অবশ্য ঢাকার মেডিকেল টিম ও চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রেরিত পানি পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়া যায়নি। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় ভায়াবহ আকারে ডায়রিয়ার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়লে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ পৌর পানি পান থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন। গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের বেশ কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদের প্রায় সকলেই বলেছেন, আমরা তো পানি ফুটিয়েই পান করেছি। এরপরও ডায়রিয়া হলো কেন? এ প্রশ্নের অবশ্য জবাব গতকাল স্বাস্থ্য বিভাগ দিতে পারেনি। তাদের অভিমত, পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত করে কারণ বলতে পারবো না। যেহেতু ডায়রিয়া পানি ও খাবারবাহী রোগ সেহেতু বিশুদ্ধ পানি ও বাসি-পচা খাবার পরিহার করতে হবে। গণহারে ডায়রিয়া আক্রান্তের খবর পেয়ে ঢাকা থেকে দুটি মেডিকেল টিম চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছায়। ঝিনাইদহের দুটি মেডিকেল টিম এবং চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ৪টি মোট ৬টি মেডিকেল টিম ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।

অপরদিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের টয়লেটগুলোতে মল ত্যাগের পর হাত ধোয়ার জন্য সাবান না থাকায় চুয়াডাঙ্গা রেলপাড়ার ছেলে বর্তমানে আলমডাঙ্গা স্টেশনপাড়ার বাসিন্দা শামীম এজাজ ১০ টাকা মূল্যের ১শ’টি সাবান দিয়েছে।

গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে মোট ১শ ১৬ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন। এ দিয়ে গত ১ আগস্ট থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১’শ পার। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা বাগানপাড়ায় ডায়রিয়া আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৭, মসজিদপাড়ায় ১১৯, মাঝেরপাড়ার ১০৫, জিনতলাপাড়ার ৯৭, আরামপাড়ার ৪২, মুক্তিপাড়ার ২৩, পোস্ট অফিসপাড়ার ৩৩, শেকরাতলার মোড়পাড়ার ১৫ ও অন্যান্য পাড়ার ৩শ ৭ জন। বিভিন্ন গ্রামের ১১৬ জন। চুয়াডাঙ্গায় মাত্র কয়েকদিনে এতোজনের ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি নতুন রেকর্ড গড়েছে।