পে-স্কেল জটিলতা নিরসনে প্রেষণের সব কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত

স্টাফ রিপোর্টার: প্রশাসন ক্যাডার বর্হিভূত ২৬ ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত কর্মস্থলের সাংগঠনিক কাঠামোয় আমূল সংস্কার আনা হচ্ছে। সংস্কারে মূল উদ্দেশ্য হবে প্রতিটি ক্যাডারে পদোন্নতির সুযোগ তৈরি করা এবং উচ্চতর স্কেলে বেতন-ভাতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এ কারণে প্রশাসন ক্যাডারের অন্তত ২ হাজার কর্মকর্তাকে (প্রেষণে অন্যান্য ক্যাডার প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত) পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে এবং সেসব জায়গায় সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তাকে পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হবে। সাধারণত যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রেষণ বা ডেপুটেশনে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হয় সেসব প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো যখন তৈরি করা হয় তখনই সেখানে পেষণ পদ নির্ধারণ করে রাখা হয়। ফলে এসব পদে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ক্যাডার কর্মকর্তারা যেতে পারেন না। অর্থাৎ এগুলো ব্লক হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রেষণ কাম্য নয়। প্রকৃত পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে প্রশাসন পরিচালিত হবে সেটি কাক্ষিত। যে কর্মকর্তা যে ক্যাডারের, তাকে সেই ক্যাডারের পদগুলোতেই রাখার বিষয়ে কথা হয়েছে। এতে বিশেষায়িত কর্মকর্তাও তৈরি হবে। তবে সবকিছু রাতারাতি সম্ভব নয়। বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখতে হবে। পর্যায়ক্রমে প্রেষণ বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, পদোন্নতির সোপান তৈরিতে কাজ করা হচ্ছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। সেগুলো দ্রুত পাওয়া গেলে দ্রুত কাজ শেষ করা যাবে। তিনি বলেন সময়ের প্রয়োজনে প্রশাসনিক কাঠামোয় সংস্কার আনা হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রকৃচি-বিসিএস (২৬ ক্যাডার) সমন্বয় কমিটির সাথে সচিব কমিটির অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। তবে পে-স্কেল সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ২৭ ক্যাডার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সুপারিশ চাওয়া হলেও গতকাল পর্যন্ত মাত্র দুটি ক্যাডার সংগঠন তাদের সুপারিশ সচিব কমিটির কাছে দিয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারের সুপারিশ এখনো মন্ত্রণালয়ে রয়েছে বলে বৈঠকে জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে কমিটির আহবায়ক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ বৈঠকে বলেন, পে-স্কেল সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে কমিটি দ্রুত কাজ করতে চায়-কিন্তু সুপারিশ না আসার ফলে তারা তা করতে পারছে না। কমিটির সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বলা হয়, ক্যাডার কর্মকর্তার বাইরে যে সকল দফতর ও সংস্থায় নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের (নিয়োগ) পদায়ন হয় তাদের সাংগঠনিক কাঠামোও পর্যায়ক্রমে সংস্কার করা হবে।
বৈঠকে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম এমপি, সদস্য সচিব মো. ফিরোজ খান, সদস্য অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান, প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূইয়া, প্রকৌশলী মো. আব্দুস সবুর, মো. মোবারক আলী, স. ম. গোলাম কিবরিয়া, অধ্যাপক নাসরীন বেগম, আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার, খায়রুল আলম প্রিন্স উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হেলাল উদ্দিন, যুগ্মসচিব (কলেজ) জালাল উদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) কবির বিন আনোয়ার উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে জনপ্রশাসন সচিব জানান, সব ক্যাডারের সমস্যা সমাধানে সুপারিশ চাওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ২টি সুপারিশ পাওয়া গেছে। তিনি জানান, সুপারিশ পেতে দেরি হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুপারিশ বিশ্লেষণ করে সমাধান দেয়া সম্ভব হবে না।
বৈঠকে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, অন্য ক্যাডারের চেয়ে তাদের সমস্যা বেশি। উচ্চ স্তরে পদ না থাকায় একই পদে দীর্ঘদিন থাকতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, এসব ক্ষেত্রে পদসংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। শিক্ষা অধিদফতরের মাধ্যমে সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখনও ওই সুপারিশ জনপ্রশাসনে পাঠানো হয়নি বলে বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সভায় শিক্ষা ক্যাডারের বিদ্যমান চতুর্থ গ্রেডের পদগুলো তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত করা সংক্রান্ত বেতন বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানানো হয়।
প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বৈঠকে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি বেশি। আবার অন্য কাডারের পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণ (ডেপুটেশন) দেয়া হয়। এতে ওই সব ক্যাডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জবাবে মুখ্য সচিব বলেন, একবারেই বিষয়টির সমাধান দেয়া যাবে না। ধীরে ধীরে করতে হবে। ধীরে ধীরে এভাবে ডেপুটেশনের সংখ্যা শূন্য কোটায় নিয়ে আসা হবে। এছাড়াও নিজস্ব ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিস বহির্ভূত সকল প্রেষণ বাতিল করার বিষয়ে সভায় ঐকমত্য হয় বলে সূত্র জানায়।
বৈঠকে উপজেলা ব্যবস্থাপনার বিষয়েও আলোচনা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ইতঃপূর্বে জারি করা অফিস আদেশ সংশোধন করা হচ্ছে। এছাড়াও ৮ম বেতনস্কেলের মাধ্যমে সৃষ্ট প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ক্যাডার-নন-ক্যাডার বৈষম্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, প্রশাসন ক্যডার বহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের গ্রেড-১, গ্রেড-২ এ প্রবেশ বা উচ্চতর স্কেলে পদোন্নতির সুযোগ তৈরিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সায় দিয়েছেন। তিনি এ প্রস্তাব পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নিতে সচিব কমিটিকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যেসব গ্রেডে ১০০ সদস্য আছেন সেসব ক্যাডারে কমপক্ষে ১টি প্রথম ও ১টি দ্বিতীয় গ্রেডের পদ সৃষ্টি করা হবে। পরিবার পরিকল্পনা, কারিগরি, শিক্ষা সমবায় ইকনমিক, পরিসংখ্যান ও টেলিকমে মোট ৬টি পদ সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ প্রশাসন বহির্ভূত আলোচ্য ক্যাডারে প্রথম শ্রেণির পদ হবে ৩৮টি। একইভাবে আনসার, সড়ক ও জনপথ, সাধারণ শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশী, প্রাণিসম্পদ, মত্স্য ডাক, গণপূর্ত ,খাদ্য, ও বন ক্যাডারে একটি করে ২য় গ্রেডের মোট ১০টি পদ সৃষ্টি হবে। ফলে এ গ্রেডে মোট পদ সংখ্যা ১০১টি। তবে বাণিজ্য ক্যাডারে কোনো ২য় গ্রেডের পদ থাকবে না। এছাড়া সমবায় এবং পরিসংখ্যান ক্যাডারে একটি করে তৃতীয় গ্রেডের মোট ২টি পদ সৃষ্টি করা হবে। এর ফলে ৩ শতাংশ কর্মচারী ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতির সুযোগ পাবেন। এতে প্রশাসন ক্যাডারে ৫ম গ্রেড থেকে ৪৫টি পদ ৪র্থ গ্রেডে আসবে। কৃষিতে ৩৬টি ৪র্থ গ্রেডের ক্যাডার পদ বহাল রয়েছে। কারিগরি শিক্ষায় ৪র্থ গ্রেডের পদ হবে ৩০টি। প্রাণিসম্পদ বিভাগে থাকছে ৪০টি ৪র্থ গ্রেডের পদ। মত্স্য ক্যাডারে ২৫টি ৪র্থ গ্রেডের পদ থাকবে। ৪র্থ গ্রেডে বর্তমান পদ সংখ্যা ২ হাজার ২৫১টি। এখন হবে ২ হাজার ৪২৭টি।
এছাড়াও ৮ম গ্রেডে ৩ বছর, ৭ম গ্রেডে ৪ বছর, ৬ষ্ঠ গ্রেডে ৫ বছর, ৫ম গ্রেডে ১০ বছর, ৪র্থ গ্রেডে ১২ বছর, ৩য় গ্রেডে ১৪ বছর, ২য় গ্রেডে ১৭ বছর এবং ১ম গ্রেডে ২০ বছর সন্তোষজনক চাকরিকাল পূর্ণ করলে এবং পদশূন্য থাকলে পরবর্তী উচ্চতর স্কেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপনীত হবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে পৃথক বৈঠক: প্রকৃচির সাথে বৈঠকের পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে পৃথক বৈঠক করেন সচিব কমিটি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি অধ্যাপক ইমদাদুল হক ও বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ এহসান। বৈঠক সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত অধ্যাপকদের মধ্য থেকে ২৫ শতাংশের জন্য জনপ্রশাসন সচিবের সমান বেতন স্কেল (গ্রেড-১) ও আর ওই বেতন স্কেলে কর্মরতদের ১২ শতাংশের জন্য নির্ধারিত শর্তে জেষ্ঠ্য সচিবের সমান বেতন স্কেল (সুপারগ্রেড) চালুর জন্য সচিবদের সাথে আলোচনা করা হয়। এ সময় সুপার গ্রেডের অধ্যাপকদের সম্মানীয় অধ্যাপক ও গ্রেড-১ এর অধ্যাপকদের সিনিয়র অধ্যাপক পদ দেবার ব্যাপারে আলোচনা হয়।
বৈঠকের ব্যাপারে অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেতন কাঠামো নিয়ে তারা একটা গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক সমাধান চান। সমস্যা নিরূপনে যে রূপকাঠামো দেয়া হয়েছে তার কিছু কিছু বিষয় নিয়ে এখনো সমস্যা আছে। সেগুলো নিরসন করতেই এই আলোচনা। তিনি জানান, আগামী ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যদি সমাধান না হয় তবে ফেডারেশন জাতির সামনে ফেডারেশনের পর্যালোচনা তুলে ধরবে।