পুলিশের প্রতিবেদনে মেহমানদের সাথে নিরুদ্দেশ সালাহ উদ্দিন!

পাঁচ সংস্থার হাইকোর্টে প্রতিবেদন : কারও কাছেই খোঁজ নেই

 

স্টাফ রিপোর্টার: উত্তরার যেই বাসা থেকে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে তুলে নিয়ে যাওয়ার দাবি করা হচ্ছে ঘটনার দিন সেই বাসা থেকে রায়হান নামের একজন তার চার/পাঁচজন মেহমানের সাথে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন বলে পুলিশের তদন্তে বের হয়ে এসেছে। গতকাল রোববার পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে হাইকোর্টে পাঠানো উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলামের তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্যই দেয়া হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ দাবি করে আসছেন, ১০ মার্চ রাত ১০টার দিকে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি রোডের ৪৯/বি নম্বর ভবনের দোতলা বাসা থেকে তার স্বামীকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

তবে ওসি রফিকুল ইসলামের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে বাড়িটির দারোয়ান আক্তার জানায়, ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ডিএমডি হাবিব হাসনাত চারদিন আগে সস্ত্রীক বাসা ছেড়ে চলে যান। যাওয়ার সময় রায়হান নামের একজন পুরুষ মেহমান রেখে যান। হাসনাত সাহেব যাওয়ার সময় বলে যান তাদের অনুপস্থিতিতে মেহমান বাসায় থাকবেন।

দারোয়ান আক্তার আরও জানায়, রাত ১১টা পর্যন্ত ভাড়াটিয়ারা বাসায় যাওয়া-আসা করেন। ১০ মার্চ রাত ৯টার দিকে গাড়ি নিয়ে চার/পাঁচজন মেহমান দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশের হাসনাত সাহেবের বাসায় আসেন। আনুমানিক আধাঘণ্টা পর ওই মেহমানদের সঙ্গে আগের পুরুষ লোকটি নিচে নেমে গাড়িযোগে চলে যান। তবে ওই লোকটি সালাহ উদ্দিন আহমেদ কিনা তা তারা জানেন না। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাসার আসা- যাওয়ার লোকগুলোর গায়ে কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক ছিল না। তাদের সাথে কোনো অস্ত্র ছিলো না। বাইরে রাখা গাড়ি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ির মতো মনে হয়নি। হাতকড়া ছিলো না। মেহমানকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়নি। অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, এখান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কাউকে ধরে নিয়ে গেছে এমন তথ্য জানা নেই। এমনকি হাবিব হাসনাত সাহেব মেহমান রেখে অন্যত্র কোথায় গেছে তাও তারা জানেন না। তবে তাদের ব্যবহৃত গাড়িটি দু-তিনদিন ধরে গ্যারেজে নেই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার সত্যতা নিরূপণের জন্য হাবিব হাসনাত ও তার স্ত্রী সুমনার সন্ধান করে জানতে পারি যে, হাবিব হাসনাত তার ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছেন। সুমনা তার বাবার বাড়িতেও নেই। উল্লেখ্য, এ দম্পতির উভয়েরই দ্বিতীয় বিবাহ। উভয়ের প্রথমপক্ষের সন্তান থাকলেও তারা তাদের সাথে থাকেন না। তাদের মোবাইল দুটি বন্ধ পাওয়া যায়। এমতাবস্থায় কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, সালাহ উদ্দিন আহমেদ আলোচ্য বাসায় ছিলো বা তাকে গ্রেফতার বা অপহরণ করেছে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে ওসি রফিকুল ইসলামের এ তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াও সালাহ উদ্দিনের ব্যাপারে একটি জিডি (সাধারণ ডায়েরি) নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ওসি রফিকুল ইসলাম নিজে ১১ মার্চ তারিখে ওই জিডি করেন। জিডিতে বলা হয়, সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ২০-২৫ জন সাংবাদিকসহ থানায় হাজির হয়ে মৌখিক অভিযোগ করেন যে ১০ মার্চ তারিখে রাত আনুমানিক ৯ থেকে ১০টার মধ্যে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি রোডের, ৪৯বি বাড়ির তৃতীয় তলা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে শাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মোবাইল ফোনে অজ্ঞাতনামা কারও সাথে আলাপ করে জানায়, তৃতীয় নয় দ্বিতীয় তলা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জিডি করার জন্য লিখিত কোনো আবেদন বা অভিযোগ নিয়ে আসেনি। বা তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছে বা তিনি নিজে উল্লেখিত বাসায় ছিলেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি (হাসিনা আহমেদ) জানান, তিনি নিজে ওই বাসায় বসবাস করেন না এবং তিনি নিজে ওই বাসায় উপস্থিত ছিলেন না। একপর্যায়ে তিনি জানান, দুবাই থেকে ফোন করে তাকে জানানো হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তার স্বামীকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকা সত্ত্বেও তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কেন জানাননি-এমন প্রশ্নেরও তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকায় সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য সালাহ উদ্দিন সাহেবের স্ত্রীকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি কোনো লিখিত অভিযোগ ছাড়াই থানা এলাকা ত্যাগ করেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে ডায়েরি নথিভুক্ত করেন ওসি রফিকুল ইসলাম। পরে ওসি নিজেই এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তদন্ত করেন।

সালাহ উদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করতে ও আদালতে হাজির করার প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানিকালে রোববার সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জিডি ও তদন্ত প্রতিবেদনটি আদালতে তুলে ধরেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ছাড়াও ৱ্যাব, সিআইডি, এসবি ও ডিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে পাঠানো পৃথক পৃথক প্রতিবেদন আদালতে তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

এসব প্রতিবেদনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ তাদের হেফাজতে নেই বা তার সম্পর্কে অবহিত নয় বলে জানানো হয়। তবে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়। ৱ্যাবের প্রতিবেদনে শুধু এক লাইনে বলা হয়, সালাহ উদ্দিন আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া ডিবির পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। কোনো এফিডেভিট ছাড়াই প্রতিবেদনগুলো আদালতে জমা দেয়া হয়। এর তীব্র বিরোধিতা করেন সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রীর আইনজীবীরা।

১১০১ চিকিৎসকের উদ্বেগ!: সালাহ উদ্দিন আহমেদ নিখোঁজের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। গতকাল রোববার বিএমএ’র সাবেক কার্যকরী সদস্য ডা. এসএম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে ১১০১ চিকিৎসক বলেন, দেশের একজন সুনামধন্য নাগরিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক আমলা যদি ৪ দিন ধরে নিখোঁজ থাকেন এবং তা যদি আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠে তা হলে দেশের সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। অনতিবিলম্বে সালাহ উদ্দিনকে আইনের কাছে সোপর্দ করার দাবি জানানোর পাশাপাশি এর ব্যত্যয় হলে তার দায়দায়িত্ব সরকারকে বহন করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা।