পুত্র হত্যার ৭ বছর পর ব্যবসায়ী আনোয়ার খুন

হত্যার মোটিভ অন্ধকারে পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী মহলে তীব্র ক্ষোভ

 

স্টাফ রিপোর্টার: পুরনো ঢাকার ঠাঁটারি বাজার এলাকার স্কুলছাত্র জিসান (১১) খুন হওয়ার ৭ বছর পর তার পিতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন (৪৫) খুন হয়েছেন। কিন্তু পিতা-পুত্রের হত্যাকাণ্ডের মোটিভ এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে অন্ধকারে। পুরনো ঢাকার মেশিনারী ব্যবসায়ীসহ ৪৫টি সংগঠন ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন হত্যাকাণ্ডে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ৭ বছর আগে আনোয়ার হোসেনের স্কুলপড়ুয়া মেধাবী ছাত্র জিসান খুন হয়েছে। সেই রহস্য উদঘাটনে পুলিশ প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ৭ বছর পর ২৫ ডিসেম্বর ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন নিখোঁজ হন। তিনদিন পর তার লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। আনোয়ার হোসেনের পরিবারকে টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। অবিলম্বে ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন হত্যা রহস্য উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেফতার করা না হলে পুরনো ঢাকার ৪৫টি ব্যবসায়ী সংগঠন আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে। যেকোনো পরিস্থিতির জন্য পুলিশ প্রশাসন দায়ী থাকবে বলেও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন।

আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী ঝুনু বেগম বলেন, ২৫ ডিসেম্বর সকালে অন্যান্য দিনের মতো নবাবপুর রোডে মদনপাল লেনের সিটি মার্কেটে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে বের হন। বেলা ১২টার দিকে মেঝে ছেলে অর্পণ আহমেদের (১১) পিএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পাওয়ার খবর তিনি স্বামীকে জানান। তখন আনোয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসা ছিলেন। এটাই স্ত্রীর সাথে আনোয়ারের শেষ কথা। পুত্রের পরীক্ষার ফল শোনায় আনোয়ার খুশিতে আত্মহারা হন। ওই সময় একই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বড় ভাই মিন্টু আহমেদ ছিলেন। তিনি বলেন, ওই দিন বেলা দেড়টায় আনোয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়। এরপর আর সে ফিরেনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে বাসা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফিরে না আসায় ওয়ারী থানায় নিখোঁজ থাকার জিডি করা হয়। সম্ভাব্য স্থানে খোঁজাখুঁজি করা হয়। ২৮ ডিসেম্বর দুপুরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ বুড়িগঙ্গা নদীর হাসনাবাদ এলাকা থেকে ভাসমান অবস্থায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। তার পকেটে থাকা ভিজিটিং কার্ডের ফোন নম্বর থেকে পুলিশ ফোন করলে তার বড় ভাই ফোন রিসিভ করেন। পুলিশ লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানায় এবং লাশ সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে দেখার অনুরোধ জানায়। মা নুরজাহান বেগম, স্ত্রী ঝুনু বেগম, ভাইসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন মর্গে গিয়ে আনোয়ার হোসেনের লাশ শনাক্ত করেন। আনোয়ারের লাশ উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে নবাবপুর রোডের বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী মর্গে ছুটে যান। লাশ দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পিতা আলী আহমেদের আদি ব্যবসা মেশিনারিজ। বয়সের ভারে তিনি এখন আর চলাফেরা করতে পারেন না। ৭ ছেলে পিতার ওই ব্যবসা পরিচালনা করে সুনাম অর্জন করে আসছেন। পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বড় ভাই মিন্টু ও ছোট ভাই আনোয়ার পরিচালনা করে আসছিলেন। অন্যান্য ভাইদের পৃথক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আনোয়ার হত্যাকাণ্ডে এখনও পর্যন্ত কোনো মামলা দায়ের করেনি পরিবারের সদস্যরা।

বৃদ্ধ পিতা আলী আহমেদ ও মা নূরজাহান বলেন, নবাবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ছিলো আনোয়ারের পুত্র জিসান আহমেদ (১১)। নাতীকে হত্যা করা হলো। তার বিচার আজো পাইনি। পুত্র আনোয়ার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা এবং তার দুই পুত্র অপূর্ব আহমেদ ও জিহাদ আহমেদের (৪) ভবিষ্যত চিন্তা করে জিসান হত্যাকাণ্ড নিয়ে কীভাবে বিবাদীদের সাথে মীমাংসা করা হয়েছিলো তা পিতামাতা ও অন্য ভাইয়েরা জানেন না। এ নিয়ে আনোয়ারের ওপর ভাইয়েরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। বেঁচে থাকা ছয় পুত্রের নিরাপত্তা কিংবা বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কথা বিবেচনা করে আনোয়ার হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা করতে সাহস পাচ্ছেন না বলে বৃদ্ধ পিতা-মাতা জানান। তবে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছেন। ময়না তদন্তকালে চিকিত্সক আনোয়ারের ফুসফুস পর্যন্ত বালু ছিল বলে জানান। তাকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হতে পারে। এটা পুলিশ তদন্তের ওপর নির্ভরশীল বলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের একজন অভিজ্ঞ চিকিত্সক জানান।

ছোট ভাই মিন্টু আহমেদ বলেন, তার ভাই আনোয়ার সাঁতার জানতেন না। তাকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিলেও তিনি বাঁচতে পারতেন না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে পরিবারের দাবি। স্ত্রী ঝুনু জানান, আনোয়ারের সাথে ২১ বছরের দাম্পত্য জীবন। সকালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়া এবং সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে বাসায় ফেরা ছিলো তার চিরন্তন অভ্যাস। নামাজ পড়তেন পাঁচ ওয়াক্ত। মাঝে মাঝে ঠাটারি বাজারের বাসায় পিতা-মাতাকে দেখতে যেতেন। দুপুরের খাবার মা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দিতেন। পুত্র আনোয়ার সম্পর্কে মা নূরজাহান একই মতামত দেন। আনোয়ারের ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। আগামী ২/১ দিনের মধ্যে পরিবারের পক্ষ থেকে আনোয়ার হত্যা মামলা দায়ের করা হবে বলে জানানো হয়। পরিবার ব্যর্থ হলে ব্যবসায়ীরা মামলা করবেন বলে জানান।

২০০৬ সালের ১৮ মে ঠাটারি বাজারের নিহত আনোয়ার পুত্র জিসান সকাল ৯টায় বাসার কাছে হোটেলে নাস্তা আনতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। ওই দিন রাতে পাশের বাসা থেকে জিসানের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। হত্যা করার ঘটনায় ভাঙচুরসহ পুরনো ঢাকা ছিলো উত্তাল। স্কুল-কলেজে জিসান হত্যাকাণ্ড নিয়ে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়। জিসান হত্যাকাণ্ডে পিতা আনোয়ার বাদী হয়ে সুত্রাপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। এক বছর পর মামলাটি কীভাবে শেষ হলো পরিবারের কেউ জানে না বলে আনোয়ারের ভাইয়েরা জানান। জিসান হত্যাকাণ্ডের সাথে আনোয়ার হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র রয়েছে কি-না এ নিয়ে সন্দেহ করছেন অনেকে।

এ ব্যাপারে মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ বলেন, ব্যবসায়ী আনোয়ার হত্যা মামলা অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই হত্যা মামলার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।