পিতার মৃত্যুবার্ষিকীর ওরশে খুন হলো ছেলে জাকির : নেয়া হলো না ফকিরত্ব

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে কামরুজ্জামান বেল্টু: পিতার ওফাত দিবসে ওরশ রাতে ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি কোপে খুন হয়েছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের আলুকদিয়া আকন্দবাড়িয়া গাংপাড়ার জাকারিয়া আলম ওরফে জাকির (৩২)। তিনি ছিলেন ক্ষুদ্র পান ব্যবসায়ী। গতপরশু রাতেই সাধু সংঘের সাধুত্ব তথা ফকিরত্ব গ্রহণের কথা ছিলো। সাধুত্বের বদলে পরশু রাতে জুটলো নৃশংসতা।
পুলিশ জাকারিয়া আলম ওরফে জাকিরকে বহন করা করিমনচালক মেহেরপুর জেলা সদরের সিংহাটির রাশেদুল ইসলামকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। গতরাতেও চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশ তার জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রাখে। সূত্র বলেছে, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে সে যে তথ্য দিয়েছে তা অসঙ্গতিপূর্ণ। ফলে হত্যার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি ঘোরতর সন্দেহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য গতকাল শুক্রবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কেউ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেনি।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের আলুকদিয়া ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া গাংপাড়ার মৃত ফজলুর রহমান ছিলেন ফকিরতন্ত্রের একজন সাধক। ৭ বছর আগে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গতপরশু দিনে ও রাতে পার্শ্ববর্তী গুচ্ছগ্রামের অদূরবতী আমবাগানে আয়োজন করা হয় ওরশ। পরশু রাত ১২টার দিকে ওরশ থেকে লেপ কাঁথা নেয়ার জন্য মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফেরেন। বাড়ি থেকে লেপ-কাঁথা বালিশ নিয়ে শ্যালোইঞ্জিনচালিত করিমনযোগে রওনা হন ওরশের স্থলে। সেখানে পৌঁছুনোর আগেই গুচ্ছগ্রামের নিকট রাস্তার পাশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে খুন করা হয়। ঘটনাস্থলের পাশেই কয়েকটি বাড়ি থাকলেও আলমসাধুচালক দৌড়ে পৌঁছায় ওরশ স্থলে। একটি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে মাইকে প্রচার করে জাকিরকে ডাকাতে ধরেছে। এ কথা শুনে ওরশের লোকজন ছুটতে শুরু করেন ঘটনাস্থলের উদ্দেশে। সেখানে পৌঁছে দেখেন রাস্তার পাশে গফুর মেম্বারের পুকুর প্রান্তে ধড় আর রাস্তার দিকে মাথা দিয়ে পড়ে আছে জাকিরের নিথর দেহ। অপরদিকে ওরশ ভেঙে যায়। উপস্থিত সাধু ফকিরানদের সকলেই ফিরতে শুরু করেন।
খবর পেয়ে রাতেই চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মৃতদেহ উদ্ধার করে। গতকাল শুক্রবার সকালে মৃতদেহ নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল মর্গে। দুপুরে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। বাদ মাগরিব গ্রাম্য কবরস্তানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়ে বলেছেন, যেখানে ওর পিতার ওরশ হচ্ছিলো, সেখানেই ওর পিতার কবর রয়েছে। ওই কবরের জমি ১ একর ৫৯ শতক। জমিটি সাধুসংঘের জন্যই দেয়া হয়। সেখানে সাইনবোর্ডে ঝুলিয়ে কয়েকজন দাতার নামও লেখা রয়েছে। খুনের পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে বলেছে, সাধুদের আস্তানার ওই জমি নিয়ে বিরোধের কারণে খুন? নাকি আস্তানায় পরশু রাতে কয়েকজন এসে কৌশলে অবস্থান নিয়ে পূর্ব বিরোধের সূত্র ধরে কুপিয়ে খুন? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজছে পুলিশ। কারণ, যখন বাড়ি থেকে কাঁথা বালিশ নেয়ার জন্য জাকির মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয়, তখন ৬/৭ জনের একটি দল ওরশ স্থল থেকে উঠে পড়ে। তারা কোথায় যায়? সে প্রশ্নের জবাব অবশ্য মেলেনি। সূত্র বলেছে, যারা ওরশ থেকে উঠে হঠাৎ আড়াল হয় তাদের সাথেই এক সময় মেশামিশি করতো জাকির। জাকিরের কারণে ওই বাগানসহ এলাকায় তেমন কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে সাহস পেতো না। সে কারণেই খুনের ঘটনা কি-না তা খতিয়ে দেখারও তাগিদ দিয়েছে স্থানীয় একাধীকসূত্র। দুবৃত্তরা খুনের জন্যই রাস্তার পাশে ওৎ পেতে ছিলো। ডাকাতি নয়। খুন করে খুনিরা দ্রুত সটকে পড়ে। পরে লাশ উদ্ধারের সময় মৃতদেহের পরনে থাকা পোশাকের পকেট থেকে উদ্ধার করা হয় নগদ ৪ হাজার টাকা, একটি মোবাইলফোন।
জাকারিয়া আলম ওরফে জাকির ছিলেন দু সন্তানের জনক। বড় ছেলে সাইম স্ট্যান্ডার ওয়ানের ছাত্র। ছোট ছেলে শেফাতের বয়স বর্তমানে ২ বছর। জাকিরের স্ত্রী সালমা খাতুন তার স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, রাত আনুমানিক ১২টার দিকে বাড়ি থেকে লেপ কাঁথা বালিশ নিয়ে আলমসাধুতে ওঠে। আমি দরজা দিয়ে ঘরে শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর আসে। জাকিরের মা ফিরোজা খাতুন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, যারা খুন করেছে তারা যদি কিছু টাকা নিয়েও আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতো!
নিহত জাকারিয়া আলম জাকিরের মামা মোতালেব শাহ বলেছেন, জাকির পানের ব্যবসা করতো। কোনো ঝুটঝামেলার মধ্যে থাকতে দেখিনি। হাতিকটায় একটি খুন হলে জাকিরের নাম জাড়ায় পুলিশ। এছাড়া জাকিরের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগের কথা আমাদের জনা নেই।
জাকারিয়া আলম জাকির খুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকার উৎসুক নারী-পুরুষ আত্মীয় স্বজন দেখতে ভিড় জমায়। সাথে ছিলো দূর দূরান্ত থেকে আসা ফকিরতন্ত্রের সাধু ফকির। আকন্দবাড়িয়া গংপাড়ায় গতকাল অসংখ্য নারী-পুরুষের ভিড় ঠেলে সকলকে চলাচল করতে হয়। এদের অধিকাংশেরই মুখে ছিলো খুনি ধরে আইনে সোপর্দের দাবি।