পিছু ছাড়েনি ডায়রিয়ার প্রকোপ : পানিতে মলের উপস্থিতির কারণেই পরিস্থিতি বেসামাল

 

চুয়াডাঙ্গা পৌর সরবরাহকৃত পানি অতিরিক্ত ফোটাতে হবে : বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়ার আগে সুতি কাপড় ৪ ভাজ করে ছেকে নেয়ার পরামর্শ

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়ার প্রকোপ পিছু ছাড়ছে না। গতকাল শুক্রবারও চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে প্রায় ১শ ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জন শিশু। গতকাল পৌর এলাকার ডায়রিয়া আক্রান্তদের কয়েকজন অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, পানি ফুটিয়ে পান করার পরও তো আমরা সুস্থ থাকতে পারলাম না। কেন? এ প্রশ্নের জবাবে মেডিকেল টিমের একাধিক সদস্য বলেছেন, পানি সম্ভবত যথেষ্ট ফোটানো হয়নি। পৌর সরবরাহকৃত পানিতে যে পরিমাণের জীবাণুর অস্তিত্ব মিলেছে তা চমকে ওঠার মতো। তাছাড়া আক্রান্ত রোগীর মাধ্যমে জীবাণু যেহেতু গামছা ও পোশাকসহ ব্যবহৃত আসবাবপত্রের মাধ্যমেও সংক্রমিত হয়, সেহেতু বাড়তি সতর্কতার অভাবেই ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব অব্যাহত রয়েছে।

চুয়াডাঙ্গায় পৌরসভা সরবরাহকৃত পানিতে মানুষের মলের উপস্থিতির কারণে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টায় সিভিল সার্জন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) প্রফেসর বেনজির আহমেদ এ তথ্য জানান। এ সময় মন্তব্য করতে গিয়ে চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন বলেন, পৌর সরবরাহকৃত পানির পাইপ পূর্ণাঙ্গভাবে পরীক্ষা করে পুনঃস্থাপন ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। ব্যয় সঙ্কুলানের জন্য উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। একই সাথে টয়লেটের পাইপ পয়ঃনিষ্কাশন ড্রেনের সাথে যুক্ত করা ব্যক্তিদের জানাতে গিয়ে উল্টো বাধার মুখে পড়েছে পৌরকর্মীরা। শক্ত হাতে তা প্রতিহত করা হচ্ছে। ১৪ আগস্টের মধ্যে টয়লেটের সরাসরি পাইপ ড্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন না করলে ঘোষণা অনুযায়ী শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ছাড় পাবেন না কেউ। চুয়াডাঙ্গা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের নির্বাহী প্রকৌশলী ওমর আলী বলেছেন, নিরাপদ বিশুদ্ধ পানির জন্য ইতোমধ্যে বাগানপাড়ায় দুটি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। অন্য এলাকায় আরো টিউবওয়েল স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ড. মামুন পারভেজ, সিভিল সার্জন আজিজুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. রশীদুল হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মল্লিক সাঈদ মাহবুব ও পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দারসহ স্বাস্থ্যবিভাগ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কর্মকর্তারা বলেন, যেকোনো উপায়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে আগামীতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।

চুয়াডাঙ্গা ডায়রিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক প্রফেসর ডা. বেনজির আহমেদ, খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ডা. মামুন পারভেজ গতকালই চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছান। সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় শেষে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের সাথে কথা বলেন। সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে ঘুরে ফিরেই পৌর সরবরাহকৃত পানি ও পানির বিশুদ্ধতার বিষয়টি উঠে আসে। ঢাকাস্থ প্রতিনিধি দলের ডা. ফারহানা হক পানি বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে বলেন, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় ডায়রিয়া সংক্রমিত এলাকার পানি পরীক্ষা করে যে রিপোর্ট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ পেয়েছে তা চমকে ওঠার মতোই। ১শ মিলি লিটার পানিতে এক ভাগ নয়, শূন্য দশমিক এক ভাগ থাকলেও সে পানিকে বিশুদ্ধ পানি বলা যায় না। সে কারণে এ পানি অল্প ফোটালে হবে না। বেশি সময় ধরে ফোটাতে হবে। তাছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়ার আগে ওই পানি সুতি কাপড় ৪ ভাজ করে পানি ছেকে নেয়ার পর বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে বিশুদ্ধ করতে হবে। তা না পারলে এ পানি পরিহার করে টিউবওয়েলের পানি পান করাই নিরাপদ হবে। এ ছাড়াও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়া এলাকায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যে হারে মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হচ্ছে তা অব্যাহত কোনোভাবেই কামনা করা যায় না।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের পক্ষ থেকে ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলামের কাছে খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ওষুধসহ স্বাস্থ্য উপকরণ প্রদান করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১০টায় চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অ্যাড. সেলিম উদ্দিন খান সিভিল সার্জনের নিকট উপকরণ প্রদান করেন। প্রদানকৃত মালামালগুলোর মধ্যে রয়েছে, দু হাজার পিস খাবার স্যালাইন, ট্যাবলেট সিপ্রোক্লক্সিন ৫’শটি, ট্যাবলেট মেট্রোনেডজেল দু হাজার পিস, ফিনাইন ১০ পিস, হারপিক ১০ পিস, ব্লিচিং পাউডার ৫ কেজি, লাইফবয় পাম্প হ্যান্ডওয়াস ১০ পিস, ডেটল লাক্স মিনি সাবান ৫০ পিস, টয়লেট ব্রাশ ৪ পিস ও ঝাড়ু৪ পিস। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনরেডক্রিসেন্টের সেক্রেটারি ফজলুর রহমান, কার্য নির্বাহী সদস্য হুমায়ুন কবীর মালিক, ডা. ফকির মোহাম্মদ, ওয়াহেদুজ্জামান বুলা, অ্যাড. রফিকুল ইসলাম, উপপরিচালক হায়দার আলী, ভারপ্রাপ্ত আরএমও ডা. মাসুদ রানা, ডা. নুরুদ্দীন রুমি, ডা. সোহেল, যুব রেডক্রিসেন্ট মাবুদ সরকার ও ওবাইদুল ইসলাম তুহিন।

গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ৯১ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। পূর্বের অধিকাংশ রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিলেও শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দেয়া হচ্ছে। পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের হাসপাতাল থেকে ছাপড়পত্র দেয়া হচ্ছে না। অপরদিকে অনেকেই ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেউ কেউ ক্লিনিকেও ভর্তি হচ্ছেন। গতকাল পযন্ত চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১২শ। গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ছিলো- বাগানপাড়ার ১০ জন, শেকরাতলাপাড়ার ৭ জন, জিনতলাপাড়ার ৬ জন, পোস্ট অফিসপড়ার ৬ জন, আরামপাড়ার ৪ জন, মাঝেরপাড়ার ৩ জন ও পৌর এলাকার অন্যান্য পাড়ার ৩৬ জন। বাকি ১৯ জন বিভিন্ন গ্রামের।

গত ১ আগস্ট থেকে চুয়াডাঙ্গায় ডায়রিয়ার ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে দুটি মেডিকেল টিম পর্যবেক্ষণে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছায়। তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি এ রোগীদের স্টুল সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে প্রেরণ করেছে। রোববার নাগাদ এসব পরীক্ষার রিপোর্ট চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে পৌঁছুতে পারে।