পাঠ্যবই ছাপায় পাঁচ কারণে জটিলতা

স্টাফ রিপোর্টার: মুদ্রণকারীদের বিভিন্ন অজুহাতসহ পাঁচ কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই সময়মতো ছাপা ও মান নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেশি জটিলতা হচ্ছে প্রাথমিক স্তরের বই নিয়ে। এই স্তরের এখনো কোনো বই বাঁধাই করে মাঠপর্যায়ে যায়নি। অথচ চুক্তি অনুযায়ী এই সময়ে অর্ধেক বই ছাপিয়ে প্রতিটি উপজেলায় পাঠানোর কথা।

এদিকে নবম-দশম শ্রেণির প্রায় দুই কোটি বই ছাপার দরপত্র প্রক্রিয়াই শেষ হচ্ছে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একাধিক কর্মকর্তা ও মুদ্রণকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ‘জোট বেঁধে’ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ঠেকিয়ে কম দর দিয়ে ৩২টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কাজ নেয়া, পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান দেরিতে নিয়োগ, ‘সহজ উপায়ে’ প্রাথমিকের বই বাঁধাইয়ের সুযোগ দেয়া, নিজস্ব সক্ষমতা ছাড়াই কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া এবং নবম ও দশম শ্রেণির জন্য সুখপাঠ্য করা ১২টি বিষয়ের বই ছাপানোর কাজের দরপত্র নিয়ে জটিলতার কারণে এবার পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সময়মতো বই দেওয়া যাবে না। উপরন্তু শেষ দিকে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বইয়ের মানের সঙ্গে আপস করতে হবে। ফলে এতে শিক্ষার্থীরাই ঠকবে।

অবশ্য এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং সময়মতোই বই মাঠপর্যায়ে পাঠানো সম্ভব হবে। এনসিটিবির সূত্রমতে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মোট ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ২০৭টি বই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিক (প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি) স্তরের ১০ কোটি ৩৬ লাখের কিছু বেশি বই ছাপা হচ্ছে।

এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এবার শুরু থেকেই ঝামেলা হচ্ছে। কারণ, ২০১৬ সালের মতো এবারও ‘জোট বেঁধে’ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ঠেকিয়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা কম দর দিয়ে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজ নিয়েছে দেশের ৩২টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২৭৭ কোটি টাকা। সেখানে জোট বাঁধা মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো ২৩৭ কোটি টাকায় কাজ পায়। এর মধ্যে কয়েকজন আছেন, যাঁরা একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ পেয়েছেন, যাঁদের একাধিক প্রতিষ্ঠান, এর আগে ঠিকমতো বই না দেওয়ায় জরিমানা দিয়েছে।

এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে বইয়ের গুণগত মানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। সেখানে এত টাকা কমে বই ছাপা হলে স্বাভাবিকভাবেই গুণগত মান রক্ষা করা কঠিন হবে। তবে তাঁরা জোর তদারকি চালিয়ে যাবেন।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে সমস্যা তৈরির অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী চুক্তির ৮৪ দিনের মধ্যে প্রাথমিকের বই ছাপিয়ে মাঠপর্যায়ে পাঠানোর কথা। ৪২ দিনের মধ্যে অর্ধেক এবং বাকি ৪২ দিনের মধ্যে বাকি বই দেয়ার কথা। বিদ্যালয়ে বই দেয়ার আগে সেগুলো মাঠপর্যায়ে গুদামে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে বিদ্যালয়ে বই যায়। প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার চুক্তি হয় ১৭ জুলাই। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে চুক্তির ৩৪ দিন পর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর পরিদর্শন সংস্থা নিয়োগ করে। ফলে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার কাজ শুরু করতেই ৩৪ দিন পিছিয়ে যায়। পরে মুদ্রণকারীরা দর-কষাকষি করে সময় বাড়িয়ে ২৯ নভেম্বরের মধ্যে বই ছাপিয়ে মাঠপর্যায়ে পাঠানোর সময় পান। কিন্তু দরপত্র মোতাবেক কাজ নিলেও এখন মুদ্রণকারীরা বলছেন, দরপত্র অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বই বাঁধাইয়ের কাজ করতে গেলে নির্ধারিত সময়ে কাজ দেওয়া সম্ভব হবে না। দরপত্র অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বইগুলো আলাদা কাগজে রেপিং করে বাঁধাই করে মাঠপর্যায়ে পাঠানোর কথা। কিন্তু মুদ্রণকারীরা দাবি তুলেছেন, এটি করতে গেলে বর্তমান সময়ের চেয়ে আট গুণ বেশি সময় লাগবে। এ জন্য তাঁরা চাইছেন শুধু ফিতা দিয়ে বাঁধাই করে বইগুলো পাঠাতে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্রগুলো বলছে, বই যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্যই আন্তর্জাতিক দরপত্র অনুযায়ী রেপিং করে বাঁধাই করার শর্ত দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুদ্রণকারী এটি মানতে চান না। এ জন্য তাঁরা কয়েকটি দাবিতে ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দিন ধর্মঘট পালন করেন। এতে বই ছাপার কাজ আরও পিছিয়ে যায়। এখন আবার তারা বলছেন, প্রাথমিক স্তরের বই ছাপাতে ২৯ নভেম্বর থেকে আরও ১৪ দিন (ধর্মঘটের কারণে ক্ষতি হওয়া পাঁচ দিনসহ) সময় বৃদ্ধি করতে হবে।

এনসিটিবির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মুদ্রণকারীরা এভাবে পিছিয়ে পিছিয়ে ছাপার কাজ ডিসেম্বরে নিতে পারলে শেষ দিকে যেকোনো উপায়ে বই ছাপিয়ে মাঠপর্যায়ে পাঠানোই এনসিটিবির জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। তখন আর মান ঠিকমতো দেখা সম্ভব হবে না। এনসিটিবির সূত্রমতে, বেশ কিছু বই ছাপানো হলেও বাঁধাইয়ের জটিলতায় প্রাথমিকের বই মাঠপর্যায়ে পাঠানো যাচ্ছে না। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে প্রচুর বই মাঠপর্যায়ে চলে যেত। জানতে চাইলে মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, বর্তমানে বই ছাপার কাজ যে পর্যায়ে রয়েছে, সেভাবে চললে এবং বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করলে যথাসময়ে বই দেওয়া সম্ভব হবে না।

সুখপাঠ্য করা বই ছাপায় জটিলতা: এনসিটিবির সূত্রমতে, এবার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দিয়ে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিতসহ ১২টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করে সুখপাঠ্য করা হয়েছে। এ জন্য এই ১২টি বিষয়ের ১ কোটি ৯৮ লাখ বই ছাপানোর কাজ পৃথক দরপত্রে করা হচ্ছে। কিন্তু সেপ্টেম্বর শেষ হতে চললেও এসব বই ছাপার দরপত্র প্রক্রিয়াই শেষ করতে পারছে না এনসিটিবি। সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট দুজন কর্মকর্তা বলেন, দরপত্র জমার পর মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, যেসব প্রতিষ্ঠান কম দর দিয়েছে, তাদের যথাযথ সক্ষমতা নেই। এসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিলে সমস্যা আরও বাড়বে। অবশ্য এনসিটিবি চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, এসব বই ছাপায় শেষ পর্যন্ত সমস্যা হবে না।