পশ্চিমবঙ্গের লম্পট ডাকাতদের ছবি চুয়াডাঙ্গা পুলিশ ও বিজিবির হাতে দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ

রানাঘাট মিশনারি স্কুলে ডাকাতি ও বৃদ্ধা প্রিন্সিপালকে ধর্ষণ : আজ নদীয়া পুলিশ সুপারের সাথে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপারের বৈঠক

 

ফাইজার চৌধুরী: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটে একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে ডাকাতি ও ৭৪ বছর বয়স্কা মাদার সুপিরিয়র (স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল) ধর্ষণের সাথে জড়িত সাত দুষ্কৃতীকারী যাতে সীমান্ত পার হয়ে বৈধ অথবা অবৈধভাবে বাংলাদেশে পালাতে না পারে সে কারণে চুয়াডাঙ্গাসহ ৩টি জেলার ১৪৫ কিলোমিটার সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত ৬ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের কাছে সহায়তা চেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা পুলিশ এবং বিএসএফ। একইভাবে নদীয়া জেলা পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ আইনগত সহায়তা চেয়েছেন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসানের কাছে। আজ বুধবার বিকেলে দর্শনা সীমান্তে দু দেশের পুলিশ সুপারের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট থেকে রানাঘাটের দূরত্ব ৩৭ কিলোমিটার। আর এ কারণেই গত ১৪ মার্চ মধ্যরাত থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টাব্যাপি রানাঘাট খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে নারকীয় তাণ্ডব চালানো ৭ দুষ্কৃতী যেকোনো সুযোগে চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যেতে পারে বলে ধারণা ভারতীয় গোয়েন্দাদের। আর তা রুখতেই ওই ঘটনার সাথে জড়িতদের আটকের জন্য বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষি বাহিনীর কাছে সাহায্য চাইলো বিএসএফ এবং নদীয়া জেলা পুলিশ।

৬ বিজিবি পরিচালক এসএম মনিরুজ্জামান বিজিবিএম মাথাভাঙ্গাকে জানান, গতকাল সোমবার দর্শনা সীমান্ত চেকপোস্ট, চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ এবং মেহেরপুরের সকল সীমান্তে (১৪৫ কিলোমিটার এলাকায়) স্থাপিত বিওপিতে রানাঘাট কাণ্ডে জড়িতদের ছবি পাঠানো হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে ওই আসামিরা বাংলাদেশি, এমন দাবি করা হয়েছে কি-না, এ প্রশ্নের জবাবে ৬ বিজিবি পরিচালক জানিয়েছেন এ ধরনের কোনো তথ্য তাদেরকে দেয়া হয়নি বা দাবিও ওঠেনি। অপরাধীদের কোনো দেশ নেই। বাংলাদেশে অপরাধ করে ভারতে পালিয়ে গেলে সে বা তারা যেমন অপরাধী তেমনি ওই দেশ থেকে কেউ পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে তার অপরাধও বিজিবির কাছে সমান এ কথা উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে সীমান্ত এলাকায় বাড়তি নজরদারি শুরু করেছে বিজিবি। ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছেও দেয়া হয়েছে অপরাধীদের ছবি। বৈধ অথবা অবৈধপথে রানাঘাট মিশনারি স্কুল কাণ্ডে জড়িতরা বাংলাদেশে ঢুকলেই তাদেরকে আটক করে আইনে সোপর্দ করা হবে। সার্বিকভাবে এ ইস্যুটিকে গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ৬ বিজিবি প্রধান।

চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মাথাভাঙ্গাকে জানান, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে রানাঘাট ঘটনায় জড়িতদের ছবি পাঠানো হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য সেখানকার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ তাকে অনুরোধ করলে আজ বুধবার বিকেলে দর্শনা চেকপোস্টে বৈঠকের দিন ঠিক করা হয়। ভারতের পক্ষ থেকে ঠিক কি ধরনের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে আজকের বৈঠকের পরই তা বলা সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, গত ১৪ মার্চ শনিবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের পাঁচিল টপকে ঢুকে স্কুলের ৭৪ বছর বয়সী মাদার সুপিরিয়রকে (স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল) ধর্ষণের পর নগদ ১২ লাখ টাকাসহ বহু মূল্যবান সামগ্রী লুট করে পালিয়ে যায় দূষ্কৃতীকারীরা। স্কুলের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে তাদের ছবি। ওই ফুটেজ এবং ছবি নিয়ে ঘটনার তদন্ত করছে সে দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তবে কোলকাতার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম এবং রাজ্য সরকারের কয়েকজন নেতা রানাঘাটের ঘটনার সাথে বাংলাদেশি জড়িত বলে প্রথম থেকেই একতরফা দাবি করে আসছে। তাদের যুক্তি ভোর ৫টা ১০ মিনিটে রানাঘাট হয়ে যে লোকাল ট্রেন গেদে (দর্শনা চেকপোস্টের ওপারে ভারতীয় অংশে) সীমান্ত স্টেশনে যায়, ওই ট্রেনে চেপে পালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। আরেক পক্ষের দাবি ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের গেদে-শিয়ালদাহ ট্রেনে করে দুর্বৃত্তরা পালিয়েছে বনগাঁ এলাকায়। তবে মিশনারি স্কুলের শিক্ষার্থী, অভিভাবক তথা গোটা পশ্চিমবঙ্গের সচেতনমহল এ খোঁড়া যুক্তি মানতে নারাজ। ঘটনার পরদিন থেকেই বিক্ষোভ শুরু করে সাধারণ মানুষ। তাদের দাবি রানাঘাট কাণ্ডে রাজনীতির রঙ মাখানো যাবে না। প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে একের পর এক ধর্ষনের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশেরই কূল কিনারা করতে পারেনি সেখানকার পুলিশ। এমনকি বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটক ধর্ষণের নেপথ্য অপরাধীরা এখনও অধরা। এক কথায় গোটা পশ্চিমবঙ্গে নারীদের নিরাপত্তা বাংলাদেশের চেয়ে অনেকাংশেই কম।

ওপার বাংলার সম্প্রতি রীতি অনুযায়ী সেখানে যেকোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটলেই অভিযোগের তীর ওঠে বাংলাদেশের দিকে। যেমনটি হয়েছিলো বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস অফিসে বোমা বিস্ফোরণ এবং পরে ওই ভবনে বোমার কারখানা আবিষ্কারের পর। সেখান থেকে ৩ জনকে আটকের প্রথম দিনই বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে দাবি করে বর্ধমান জেলা পুলিশ। উদ্ধার হয়েছিলো বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক। সে সময় বিজিবি এবং বাংলাদেশ পুলিশের কাছে একই ধরনের সহায়তা চেয়েছিলো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রশাসন। পরে তদন্ত করে তারা বুঝতে পারে বর্ধমানে আটক হওয়া সকলেই ভারতীয়, এখন পর্যন্ত দুজনের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। ঠিক তেমনি রানাঘাট মিশন স্কুলে বৃদ্ধা প্রিন্সিপ্যাল ধর্ষণ ও লুটপাটের পর ওই একই ধরনের দাবি তোলে সেদেশের গণমাধ্যম, এর সাথে সুর মেলান কিছু রাজনৈতিক নেতা। গতকাল মঙ্গলবার রাতে এ প্রতিবেদকের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা হয় কোলকাতার প্রথমসারির একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে। প্রশ্ন করা হয়েছিলো, তোমাদের ওখানে সকল নেতিবাচক ঘটনায় বারবার কেন বাংলাদেশকে অভিযুক্ত করো? প্রত্যুত্তরে ওই সাংবাদিকের সাফ জবাব (সত্য জবাব হতে পারে) ঘটনা ঘটার পর খবরের সাথে বাংলাদেশ জুড়ে দিলে দু একদিন পাবলিককে নিউজটা খাওয়ানো যায়! তাই বলে পুরো পশ্চিমবাংলার গণমাধ্যমকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। সবাই এ কাজটি করে না। রানাঘাট ঘটনার তীব্র নিন্দা করে ওই সংবাদকর্মী বলেন, সব ধরনের প্রমাণ থাকার পরও এতোদিনে পুলিশ কিছুই করতে পারলো না এটা মেনে নেয়া যায় না। একচেটিয়া সাধারণ মানুষদের আটক করে হয়রানি করা হচ্ছে এখানে। রানাঘাট কাণ্ডের পর তোমাদের দেশ থেকে (বাংলাদেশ) অনেকে বেড়াতে এসে পুলিশি হয়রানির মধ্যে পড়ছে।

এ খবরের সত্যতা মিলেছে ভারত ফেরত কয়েকজন বাংলাদেশির সাথে কথা বলে। রাজবাড়ী জেলার বাসিন্দা ইকলাস উদ্দিন ভারতের গেদে চেকপোস্টে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের অহেতুক জেরার মুখে পড়েন বলে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া গেদে বিএসএফ চেকপোস্টে যাত্রীদের লাগেজ তল্লাশির নামে জামা কাপড়ের ব্যাগ উল্টে পাল্টে মাটিতে ফেলে দেয়ার যে নিয়ম প্রচলিত আছে এখন তা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। প্রতিবাদ করলেই বিএসএফ বাংলাদেশিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন তারা।

সূত্রের খবর অনুযায়ী, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের কথায় পাত্তা না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যাণার্জি ইতোমধ্যেই রানাঘাট তদন্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র সাহায্য চেয়েছেন। আর পৈশাচিক সেই ঘটনার ১০ দিন পর জড়িতদের ছবি সরবরাহ করে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ আশপাশের ১৪৫ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় দুষ্কৃতীকারীদের খোঁজে সাহায্য করার অনুরোধ করলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।