নেশা : চার দিনের ব্যবধানে তিনজনের মৃত্যু

দর্শনায় রেক্টিফাইড স্পিরিট বিক্রি কোনোভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না

 

দর্শনা অফিস: রেক্টিফাইড¯স্পিরিট বিক্রি কোনোভাবেই যেন ঠেকাতে পারছে না কেউ। রেক্টিফাইড¯স্পিরিট পানে প্রায় প্রতিদিনিই ঝরছে প্রাণ। গত চার দিনের ব্যবধানে দর্শনায় তিনজন প্রাণ হারিয়েছে। এক মাসের মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে। দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছে তিনজন। অসংখ্য নেশাখোর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। রেক্টিফাইড স্পিরিট ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়ে তৈরি ভেজাল মদপানে অহরহ ঘটছে এ ধরনের দুর্ঘটনা। ভেজাল মদ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে সচেতন মহল রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছে। নেয়া হচ্ছে নানামুখি প্রস্তুতি।

দর্শনা রেলবাজারে অনুমোদিত একমাত্র কেরুজ মদ বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। দেশের একমাত্র মদ উৎপাদন কেন্দ্র কেরুজ ডিস্টিলারি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পরপরই দেশের অন্যান্য স্থানগুলোর পাশাপাশি দর্শনাতেও মদ বিক্রির অনুমোদন দেয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে। কেরুজ বাংলা মদ বিক্রির অনুমোদন থাকলেও ফরেন লিকার বিক্রির অনুমোদন দেয়া হয়নি আজও। অনুমোদিত এ মদের দোকান থেকে লাইসেন্সধারী মদ্যপদের মদ কেনার অনুমতি রয়েছে জনপ্রতি ১ লিটার হারে। এলাকার হরিজন, আদিবাসী, দাস ও হিন্দু সম্প্রদায়ের রয়েছে মদপানের লাইসেন্স। সূত্র বলেছে, ওই সম্প্রদায়গুলোর বেশির ভাগ লাইসেন্সধারী সদস্যই হতদরিদ্র। ফলে তাদেরকে ম্যানেজ করেই ওই লাইসেন্সগুলো ইস্যুর মাধ্যমে বৈধভাবে উত্তোলন করা হয়ে থাকে কেরুজ উৎপাদিত মদ। অথচ বাস্তবে তার পুরোটাই উল্টো। এদিকে কেরুজ চিনিকলের ডিস্টিলারি বিভাগের গুটি কয়েক অসাধু ব্যক্তি, পরিবহনচালক ও হেলপারের যোগসাজশে মিলের ডিস্টিলারি বিভাগ থেকে চুরি হচ্ছে বাংলা মদ ও ফরেন লিকার। চুরিকৃত মদ বিক্রি করা হয়ে থাকে এলাকার চিহ্নিত মদ বিক্রেতাদের কাছে। এ মদ পুঁজি করেই দর্শনার বিভিন্ন স্পটে এক প্রকার প্রকাশ্যেই গজিয়ে উঠেছে মদ বিক্রি ও নেশার আস্তানা। স্পটগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য দর্শনা কেরুজ আমতলা, সুইপার কলোনি, মাইক্রোবাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বটতলা, দক্ষিণচাঁদপুর লাইনপাড়া, কেরুজ প্রাইমারি স্কুলপাড়া, সিজেনাল ব্র্যাক চত্বর, আনন্দবাজার, ফুলতলা, আনোয়ারপুর, মোহাম্মদপুর, বাসস্ট্যান্ড, দর্শনা রেলবাজার, দামুড়হুদার কুড়ুলগাছি ও কার্পাসডাঙ্গা। সম্প্রতি কেরুজ উৎপাদিত মদের সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে মিনি মদ কারখানা। এ মিনি মদ কারখানাগুলোতে যেমন তৈরি করা হচ্ছে বাংলা মদ, তেমনিভাবে ফরেন লিকার তৈরির হিড়িক পড়েছে। ডিস্টিলারি থেকে চোরাইভাবে পাচার করে আনা ফরেন লিকারের লেভেল, কর্ক ও বোতল ব্যবহার করা হচ্ছে নকল ফরেন লিকার তৈরির ক্ষেত্রে। অভিযোগ উঠেছে, মদ বিক্রেতা ও ক্রেতার সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা দেয় মদ সংকট। এ সংকটের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে চিহ্নিত কয়েকজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও খোলা বাজারে অবৈধ উপায়ে মদ বিক্রেতারা। কয়েকজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নেটমোড়সহ বিভিন্ন ধরনের অ্যালকোহল জাতীয় ওষুধ বিক্রি করছে মদ বিক্রেতাদের কাছে। এছাড়া মাদককারবারীরা রেক্টিফাইড স্পিরিট ও হোমিওপ্যাথিক ওই ওষুধ দিয়েই তৈরি করছে ভেজাল মদ। তৈরি মদে মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল থাকায় তা পানে বিপাকে পড়ছে মদ্যপায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভেজাল মদ পানে গত এক মাসের ব্যবধানে মারা গেছে পাঁচজন। দৃষ্টি শক্তি হারিয়েছে তিনজন। এছাড়া অনেকেই হয়েছে বিকলাঙ্গ, হারিয়েছে স্মৃতিশক্তি, গুনছে মৃত্যুর প্রহর। ভেজাল মদ পানে গত বৃহস্পতিবার মারা গেছে কেরুজ পরিবহন বিভাগের চালক দর্শনা পৌর শহরের দক্ষিণচাঁদপুর বকুলতলাপাড়ার শামসুল ইসলাম (৫০)। পরের দিন শুক্রবার মারা গেছে দর্শনা বাসস্ট্যান্ডপাড়ার মকসেদ আলীর ছেলে দু সন্তানের জনক মোমিন (৩১)। গতকাল রোববার ভোরে মারা গেছে মোহাম্মদপুরের রতন শেখের ছেলে চার সন্তানের জনক বাবলু (৪০)। এছাড়া কয়েকদিন আগে মারা যান আজমপুর মাঠপাড়ার দু সন্তানের জনক হাকিম (৪৫) ও হরিজন সম্প্রদায়ের পাঁচ সন্তানের জনক সুনিল ওরফে পচা (৩৫)। এছাড়া ভেজাল মদ পানে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে জীবনযাপন করছে জীবননগর থানাপাড়ার ফজলু (৩৩), কেরুজ হাইস্কুলপাড়ার পাপ্পু (৩০) ও দর্শনা দক্ষিণচাঁদপুর টাওয়ারপাড়ার সুলতান (৪৫)। ভেজাল মদপানে অসুস্থের সংখ্যা রয়েছে অগণিত। ভেজাল মদকারবারীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। গতকাল রোববার দর্শনা মাইক্রোবাসস্ট্যান্ডের একদল চালক ও হেলপার মাদকের কয়েকটি ডেরায় গিয়ে ভেজাল মদ বিক্রি না করার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল কবির মাদককারবারীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে ওয়ার্ডবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। মাদককারবারীদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করার জন্য সকলকে অনুরোধ করেছেন তিনি। এছাড়া ভেজাল মদ পানে প্রায় প্রতিদিন মৃত্যুর ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে স্থানীয় পুলিশ। তারা ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করেছে।

দর্শনা আইসি ইনচার্জ এসআই মিজানুর রহমান বলেছেন, দর্শনা থেকে ভেজাল মদ বিক্রেতাদের গ্রেফতার ও আস্তানা উচ্ছেদের লক্ষ্যে পুলিশি অভিযান অব্যাহত শুরু করেছে। তিনি চিহ্নিত মাদককারবারীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।