নেপালে নিহতের সংখ্যা আড়াইহাজার ছাড়িয়ে গেছে

মাথাভাঙ্গা মনিটর: নেপালে শনিবারের ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় অন্তত ৬ হাজার মানুষের আহত হওয়ার খবর জানাচ্ছেন দেশটির কর্মকর্তারা। উদ্ধার হওয়া বহু হতাহত, আটকে পড়াদের উদ্ধার তৎপরতা আর লণ্ডভণ্ড স্থাপনা নিয়ে নেপাল কর্তৃপক্ষের দিশেহারা অবস্থার মধ্যেই রোববার আবারও কেঁপে ওঠে নেপাল। সাথে ভারত-বাংলাদেশও। এদিন বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৯ মিনিট ৯ সেকেন্ডে সংঘটিত এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো নেপালের কোদারি থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে। রোববার সন্ধ্যার পরও থেমে থেমে কম্পন হয় নেপালে। ভূমিকম্পের ঘটনায় এরই মধ্যে দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে রোববার রাত ১০টার দিকে নেপালের কাঠমাণ্ডুতে আবারও ভূমিকম্প হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিলো ৫.৪। তবে ভারতের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এ সংক্রান্ত খবর প্রচার করা হলেও মার্কিন গবেষণা সংস্থা ইউএসজিএস (ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে) এ বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

Nepal (1)

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানায়, উৎপত্তিস্থলে রোববারের ভূমিকম্পের মাত্রা ছিলো রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৭। ঢাকা থেকে এর কেন্দ্রস্থল ছিলো ৬শ কিলোমিটার দূরে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। এদিন ভারতের কোলকাতা, শিলিগুঁড়ি, মধ্যপ্রদেশ, আসাম, বিহার, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, মালদহ, হাওড়া, চব্বিশ পরগনাসহ দেশটির অনেক রাজ্য কেঁপে ওঠে। এখানে মেট্রো পরিসেবা দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। বিহারে সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ ২৭-২৮ এপ্রিল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরাঘাত হচ্ছে একের পর এক। টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই ভবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ভারতের রাজস্থান এবং ভরতপুরে নতুন কম্পনে দেয়াল ধসে এক মেয়ে নিহতসহ আহত হন আটজন। ভারতের আবহাওয়া অধিদফতরের মহাপরিচালক এলএস রাথর বলেছেন, বিভিন্ন স্থানে আবারও কম্পন হতে পারে। মহাপরিচালকের ভাষ্য, রিখটার স্কেলে চার বা তার ওপরের তীব্রতার ৩০টিরও বেশি ভূমিকম্প পরবর্তী কম্পন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। কিছু সময়ের জন্য এ ধরনের ভূকম্পন অব্যাহত থাকতে পারে। তাই জনগণের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নেপালে এর আগে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো ১৯৩৪ সালের ভূমিকম্পে। ওই দুর্যোগে সাড়ে ৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।

শনিবার দুপুর ১২টা ১১ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ। এদিন ৮ ঘণ্টায় ২৪ বার কেঁপে ওঠে নেপাল। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নেপালের লামজুংয়ের ২৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, মাত্রা ছিলো ৭ দশমিক ৮। এ ঘটনায় নেপালের ৪০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানে প্রাণ হারানো আড়াই হাজারের অধিক মানুষের মধ্যে কাঠমান্ডুতেই ৭শ’র বেশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর প্রকৃত অবস্থা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কেননা এখনও বিধ্বস্ত ভবনের নিচে আটকা পড়ে আছেন অনেক মানুষ। বিধ্বস্ত হয়েছে বহু ঘরবাড়ি। শনিবারের ভূমিকম্পে ভারতে অন্তত ৭০, তিব্বতে ১৭ এবং বাংলাদেশে তিনজন মারা যান। ইতিমধ্যে এভারেস্ট পর্বত থেকে ১৫ জনকে নিয়ে কাঠমান্ডুতে পৌঁছেছে উদ্ধারকারী বিমান। শনিবার এ পর্বতে ১৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। খবর পাওয়া যায় ৬১ জনের আহত হওয়ার। এখানে এখনও অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। ক্ষণে ক্ষণে কম্পনে হিমালয়ের বরফেও ভাঙন দেখা দিচ্ছে। বন্ধ রাখা হয়েছে এ অঞ্চলের কয়েকটি স্থানে বিমান চলাচল।

নেপালের আন্নাপুরা হাসপাতালের চিকিৎসক সামির আচার্য বলেন, শনিবার থেকে হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত অনেক মানুষের চিকিৎসা দিয়েছেন তারা, এর মধ্যে শিশুই বেশি। কাঠমান্ডুতে জাতীয় ট্রমা সেন্টারের সিনিয়র সার্জন সন্তোষ পদিল বলেন, আমাদের চিকিৎসক দলের ঘুম নেই। ইতিমধ্যেই আমরা অন্তত ১ হাজার ব্যক্তিকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছি।

খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য মানুষ: বিভিন্ন হাসপাতালে ক্ষণে ক্ষণে নেয়া হচ্ছে উদ্ধার করা হতাহতদের। দুর্ভাগ্যের শিকার হাজার হাজার মানুষের সংকুলান করতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রাচীন শহরের অলিগলিতে ঢুকতে পারছে না বুলডোজার। এতে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের আর্তনাদ শুনলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে পারছেন না উদ্ধারকর্মীরা। ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে অনেকেই খালি হাতে নেমে পড়েছেন। বহু বাস্তুহারা মানুষসহ অনেকেই আতংকে খোলা আকাশের নিচে তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছেন। প্রয়োজনীয় খাবার, পানি ও চিকিৎসা সহায়তার অভাবে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিচ্ছিন্ন রয়েছে বেশিরভাগ এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ। সবমিলিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সব ধরনের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম।

ক্ষতিগ্রস্ত ৬৬ লাখ -জাতিসংঘ: শনিবারের ভূমিকম্পে নেপালের ৬৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। রোববার কাঠমান্ডুতে সংস্থাটির কার্যালয় জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দেশটির ৩০টি জেলার। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে নেপাল সরকারকে সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে তারা। দেশটিতে ৮১ বছরের মধ্যে আঘাত হানা সবচেয়ে ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে।

বিভিন্ন দেশের সহায়তা: উদ্ধার অভিযানে অংশ নিতে দেশটিতে মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। ভারত তিন টন ত্রাণ এবং ৪০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকর্মী পাঠিয়েছে নেপালে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের তথ্য মতে, দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের একটি দল নেপালে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ মার্কিন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভূমিকম্প দুর্গতদের সাহায্যে ‘সব কিছু করার’ ঘোষণা দিয়েছেন। সাহায্য ও সহায়তার যে কোনো ধরনের অনুরোধে সাড়া দিতে ফ্রান্স প্রস্তুত বলে জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ। সাহায্যের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে পাকিস্তান। ইউরোপীয়ান কমিশন রোববার ৩.২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে নেপালে।

আটকে পড়া স্বদেশীদের খোঁজে এশিয়া: এশিয়ার দেশগুলো নেপালে তাদের হাজার হাজার নাগরিকদের খোঁজে অভিযান শুরু করেছে। ভারত ইতিমধ্যে কয়েক দফায় তাদের ৫ শতাধিক নাগরিক সরিয়ে এনেছে। চীন ইতিমধ্যে তাদের ৬৮৩ পর্যটক নেপাল থেকে সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জাপান জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত নেপালে তাদের ১ হাজার ১০০ নাগরিককে সহায়তায় একটি লিয়াজোঁ অফিস স্থাপন করেছে। অস্ট্রেলিয়া জানায়, ইতিমধ্যে তারা ৫৪৯ জন নাগরিকের মধ্যে ২০০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। এছাড়াও নিউজিল্যান্ডসহ অন্য দেশগুলোও নেপালে তাদের নাগরিকদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছে।

ক্ষতিগ্রস্তদের সন্ধানে গুগলের পারসন ফাইন্ডার: নেপালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের তথ্য পেতে পারসন ফাইন্ডার নামের টুল চালু করেছে গুগল। ভূমিকম্পে হতাহতদের সঠিক তথ্য পেতে ও তথ্য দিতে সহায়ক হবে এ টুল। এ টুলে রয়েছে দুটি বক্স। একটা হল, ‘কাউকে খুঁজছি’ (আই অ্যাম লুকিং ফর সামওয়ান)। অপর বক্সটি হল, ‘আমার কাছে তথ্য আছে’ (আই হ্যাভ ইনফরমেশন অ্যাবাউট সামওয়ান)। কোনো ভবনের নিচে আটকা পড়ে আছে এমন সন্দেহে কারও সন্ধান পেতে চাইলে ‘কাউকে খুঁজছি’ অপশনে ক্লিক করতে হবে। এরপর সেখানে তার নাম লিখতে হবে। একই ভাবে, কোনো ভবনের নিচে আটকা পড়ে আছেন কিংবা নিরাপদে রয়েছেন এমন কোনো ব্যক্তি যদি পরিবারের কাছে তথ্য দিতে চান তাহলে ‘আমার কাছে তথ্য আছে’ অপশনে ক্লিক করে নিজের নাম লিখে দিতে হবে।