নূর হোসেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে

স্টাফ রিপোর্টার: ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার ১৫ ঘণ্টা পর বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। গতকাল শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সহিদুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনকে ১১টি মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। এসব মামলার সবগুলোতেই অভিযোগপত্র হওয়ায় তাকে রিমান্ডে নেয়ার সুযোগ ছিলো না। নূর হোসেনের জামিনের জন্য কোনো আবেদন করা হয়নি। শুনানি শেষে আদালত তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে নিরাপত্তার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পাহারায় বিকালে তাকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির জানিয়েছেন, গতকাল বিকেল সোয়া চারটায় নূর হোসেনকে কারাগারে আনা হয়। এ দিকে নূর হোসেনকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হয় কয়েক হাজার মানুষ। তারা ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দেয়। পাশাপাশি নিহতদের স্বজনরা তাকে লক্ষ্য করে জুতো নিক্ষেপ করে। তারা নতুন করে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান। আদালতে হাজিরার সময় নূর হোসেনের মুখে হাসি দেখা যায়। তার পরনে ছিল খাকি রঙের প্যান্ট ও সাদা-কালো স্ট্রাইপের গেঞ্জি। বাম হাতে ছিলো নীল রঙের একটি ঘড়ি। নূর হোসেনকে আদালতে আনার আগ থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলো কয়েকশ’ সংবাদকর্মী। আদালতে তোলার ৯ মিনিটের মধ্যে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন এবং এরপর সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে করে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। নূর হোসেনকে তার নিজ এলাকা নারায়ণগঞ্জে ফিরিয়ে নেয়ার আগ থেকেই শহর জুড়ে নেয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা। সকাল সোয়া আটটায় নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে আনা হয়। এ দিকে বেনাপোল থেকে ঢাকায় আনার পর নূর হোসেনকে ঢাকার র্যাব-১ দফতরে নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতদের স্বজনরা। তবে এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই পুলিশ ও র্যাবের পাহারায় নূর হোসেনকে আনা হয়েছে।
র্যাব-১ থেকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন্স: বাংলাদেশ উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত দেয়ার একদিন পর গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে নূর হোসেনকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এরপর র্যাব হেফাজতে তাকে গতকাল শুক্রবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর উত্তরাস্থ র্যাব-১ দফতরে। সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর নূর হোসেনকে নিয়ে র্যাব-পুলিশের একটি গাড়িবহর নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়। পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সাইনবোর্ড এলাকায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন নূর হোসেনকে গ্রহণ করেন এবং গাড়িবহরসহ জেলা পুলিশ লাইন্সে নিয়ে যান। ওই গাড়িবহরের মধ্যে একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকারে ছিলো নূর হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সাত খুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামুনূর রশিদ। সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে আনার পর নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
বেলা আড়াইটার দিকে মাসদাইর পুলিশ লাইন্স থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে নূর হোসেনকে নারায়ণগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। সে সময় তার ফাঁসির দাবিতে বাইরে বিক্ষোভ করছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। শুনানি শেষে আদালত নূর হোসেনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যাসহ ২২টি মামলা রয়েছে। এছাড়া একটি মামলায় তাকে এক বছরের সাজা দেয়া হয়। আদালতের পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, ১১টি ওয়ারেন্টে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বর এই মামলার ধার্য তারিখ।
রিমান্ড না চাওয়ায় ক্ষোভ: আদালতে তোলার সময় নূর হোসেনকে হাসতে দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তবে তিনি নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, অভিযোগপত্র দাখিলের আগে নূর হোসেনকে আনলে ভালো হতো। নূর হোসেন কোলকাতায় থাকতে বলেছিলো, তাকে দেশে ফেরত নেয়া হলে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মুখ খুলবেন। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অসম্পূর্ণ একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। তিনি বলেন, সাত খুনের ঘটনায় ৬ কোটি টাকার লেনদেনের সাথে র্যাব ছাড়া আর কারা জড়িত, সে তথ্য নূর হোসেনের মুখে শুনতে চাই। হুকুমদাতা ও অর্থের যোগানদাতা কারা এগুলো প্রকাশ পেলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। তিনি নূর হোসনকে র্যাব দফতরে নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সাত খুন মামলার অভিযোগপত্র নিয়ে বিউটি আপত্তি জানালেও নারায়ণগঞ্জের জজ আদালতে তা নাকচ হয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাবেন বলেও ইতোমধ্যে জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি তিনি অভিযোগ করেছেন, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার সাথে সাথেই তার সহযোগীরাও এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে হুমকি দিচ্ছে। আমাদের লোকজনদের মারধর করছে। আমরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এ সময় তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাচ্চারা এখনো বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। আমার এক বাচ্চা অনেকদিন হাসপাতালে ছিলো।
নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে এর আগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। যেহেতু সে দেশের বাইরে ছিলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পরই অভিযোগপত্র দেয়া হলে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অন্যরাও শনাক্ত হবেন। এ ব্যাপারে তিনিও উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানান।
উল্লেখ্য, সাত খুনের পর নূর হোসেনের সাথে র্যাবের ৬ কোটি টাকার লেনদেন হওয়ার অভিযোগ করেছেন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর।
নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের বাবা আব্দুল ওহাবও মামলার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন। তিনি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলেকে ফিরে পাব না। কিন্তু আমি ইব্রাহিমসহ সাতজনকে খুনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। আমি চাই, যারা খুন করেছে আমার ছেলেকে, নূর হোসেন তাদের নাম বলে দিক।
একই ঘটনায় নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, নূর হোসেনের টাকায় র্যাব ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবে কাজ করেছে। নূর হোসেনই জানে তার পেছনে কে কে আছে। আমরা চাই, বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা নারায়ণগঞ্জবাসীসহ সারাদেশের জনগণকে জানতে দেয়া হোক।
রিমান্ড চাওয়ার সুযোগ নাই : এসপি ও পিপি: নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন বলেছেন, আলোচিত ৭ খুনের দুটি মামলাতেই গ্রেফতারকৃত ২১ আসামিই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ১৪ জন সাক্ষী স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলার ওয়ারেন্ট আছে। যার মধ্যে ১১টি মামলা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ও ২টি ফতুল্লা মডেল থানায়। ১০টি জিআর মামলা, ২টি সিআর মামলা ও একটি সাজা হয়েছে। ওই ১৩টি মামলাতেই নূর হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এর মধ্যে ১১ মামলাতেই নূর হোসেনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। যেহেতু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলাতেই আদালত থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে সেহেতু তাকে রিমান্ড চাওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, আদালতে ১১টি মামলায় নূর হোসেনকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। যেহেতু মামলাগুলোর ইতিমধ্যে চার্জ গঠন হয়ে গেছে সেহেতু রিমান্ড আবেদন করা যায়নি।
নূর হোসেনের পক্ষে ছিলো না কোনো আইনজীবী: শুনানির সময় আদালতে নূর হোসেনের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি, মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি খোকন সাহাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান মন্তব্য করেছেন, অভিযোগপত্র হয়ে গেলেও রাষ্ট্রপক্ষ ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে নূর হোসেনকে এখনও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সম্ভব।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়া যায়। সাত খুনের মামলায় র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানাসহ ২২ জন কারাগারে রয়েছে। পলাতক রয়েছেন র্যাবের ৮ সদস্যসহ ১৩ আসামি।