নির্বাচনের কাউন্টডাউন ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন

স্টাফ রিপোর্টার: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ‘কাউন্টডাউন’ ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। এ হিসাবে আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন। এ সময়সীমা অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করে আনছে প্রতিষ্ঠানটি। ইতোমধ্যে নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয় সংক্রান্ত টেন্ডার শেষে শুরু হয়েছে ছাপার কাজ। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও আচরণ বিধিমালা সংশোধন এবং নতুন দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কমিশন সচিবালয়ে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কমিশন সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। আসনভিত্তিক ভোটার তালিকার সিডি তৈরি, নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয়, প্যাকেট ও ফরম মুদ্রণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। নির্বাচনী বিষয়াদি প্রচার করতে জনসংযোগ বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নির্বাচনী কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয় বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এখনও তফসিল ঘোষণা ও নির্বাচনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়নি। শিগগিরই কমিশন বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে যথেষ্ট সময় দেয়া হবে। কমিশনের ওপর আস্থা থাকলে তফসিল ঘোষণার তারিখ ও নির্বাচনী সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কমিশনের সংলাপ হতে পারে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ রোববার কমিশন সচিবালয়ে বলেন, আইন অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করব অর্থাৎ আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে কোনো বিকল্প কমিশন ভাবছে না। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। শিগগিরই এ বিষয়ে কমিশন বৈঠক হবে। এক প্রশ্নের জবাবে শাহনেওয়াজ বলেন, নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলে ও কমিশনের ওপর আস্থা রাখলে সবার সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।

সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠিত হয়। প্রথম সংসদ অধিবেশন শুরু হয় একই বছরের ২৫ জানুয়ারি। এ হিসাবে আগামী ২৪ জানুয়ারি সংসদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হবে। সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে।

ইসি সূত্র জানায়, জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ভোটগ্রহণ ও নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার সময় ধরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেজন্য আচরণবিধিতে পরিবর্তন আসছে। এছাড়া আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। শতকরা ১০ ভাগ অতিরিক্ত ধরে ৭ লাখ ১৮ হাজার নির্বাচন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। নির্বাচনী কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট ছাপানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ব্যালট বক্স, অমোচনীয় কালি, মার্কিং সিল, সিলগালাসহ বিভিন্ন নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। তবে নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরপিও ও নির্বাচন আচরণ বিধিমালা এখনও শেষ করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। যে গতিতে আরপিও সংশোধনী করা হচ্ছে তাতে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে অনুষ্ঠেয় সংসদ অধিবেশনে এটি পাস করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন বলে ধারণা করছেন কমিশন কর্মকর্তারা। এছাড়া নতুন দল নিবন্ধনের কাজ এখনও শেষ হয়নি। বিএনএফকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও আপত্তির জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রদানসহ আনুষ্ঠানিক অনেক কাজ এখনও বাকি রয়েছে।

রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জন কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ: নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া আন্তর্জাতিক মহলে সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায় না। নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে আস্থায় আনা নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে কমিশনের সংলাপে বিএনপি অংশ নেয়নি। এ কারণে নির্বাচনী তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ করার আগ্রহ নেই নির্বাচন কমিশনের। তবে চলমান সংকট নিরসনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা রাজি থাকলে কমিশন সংলাপের উদ্যোগ নেবে। নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, নির্বাচন নিয়ে বড় দলগুলোর মধ্যে দুস্তর ফারাক রয়েছে। সেক্ষেত্রে কমিশন সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। যদি সব রাজনৈতিক দল কমিশনের ওপর ভরসা রাখে তাহলে নির্বাচন কমিশন সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনে কমিশন কোনো উদ্যোগ নেবে কিনা- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে কমিশনের করণীয় কিছুই নেই। রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নেবে।             নির্বাচনে কতটুকু প্রস্তুত ইসি: কমিশনের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, আইন ও বিধিমালা সময়োপযোগী করা, ব্যালট বাক্স, কালি, সিলসহ নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয় করা, মনোনয়ন ফরমসহ বিভিন্ন প্রকার ফরম ও প্যাকেট, নির্দেশিকা মুদ্রণ, নির্বাচনী ব্যয়ের বাজেট প্রণয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শেষ করতে হয়। তফসিল ঘোষণার পর ব্যালট মুদ্রণ, যাচাই-বাছাই ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। এ হিসাবে তফসিল-পূর্ব সময়ে নির্বাচনের মূল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়।

জানা গেছে, নির্বাচনের কাউন্টডাউন আগামী ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে। এর আগেই নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। এখনও আরপিও চূড়ান্ত হয়নি। এ কারণে আটকে আছে আচরণ বিধিমালা সংশোধন। আচরণ বিধিমালা সংশোধন না হওয়ার কারণে নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ফরম ছাপা সম্ভব হচ্ছে না। আচরণবিধিতে ওই সব ফরমের নমুনা উল্লেখ করা হয়। ওই নমুনা অনুযায়ী ছাপা হয়। কমিশন কর্মকর্তাদের মতে, নির্দিষ্ট সময়ে এসব কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে নির্বাচনে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
আরপিও ও আচরণ বিধিমালা সংশোধনের অগ্রগতি সম্পর্কে মো. শাহনেওয়াজ বলেন, আমরা আরপিও সংশোধনের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এখন সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, আগের কমিশনের রেখে যাওয়া সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর কিছু করণিক সংশোধনী এনে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই আরপিও দিয়ে নয়টি নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং এটা সংশোধন না হলে কোনো জটিলতা দেখা দেবে বলে মনে হয় না। আচরণ বিধিমালা সংশোধন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আচরণবিধি সংশোধন নিয়ে কমিশন বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। সব বিষয় বিবেচনা করে সহসাই কমিশন বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
কমিশন কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। আসনভিত্তিক ভোটার সিডি গত সপ্তাহে তৈরি করা হয়েছে। সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনের মালামাল একসঙ্গে সংগ্রহ করা হচ্ছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোচনীয় কালি ও ব্যালট বাক্স লক সরবরাহ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনডিপি। নির্বাচন কমিশন থেকে দুই নির্বাচনের জন্য ৪০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ৬ লাখ ৪৮ হাজার অমোচনীয় কালি (কলম আকারে) ও ২৪ লাখ ব্যালট বাক্স লক সরবরাহের জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। এছাড়া ৬ লাখ ৪৮ হাজার স্ট্যাম্প প্যাড, ৯০ হাজার ব্রাশ সিল, ৬ লাখ ৪৮ হাজার অফিসিয়াল সিল (ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার ব্যবহারের জন্য), ১১ লাখ ২৩ হাজার মার্কিং সিল (ভোট দেয়ার সিল) ও ১৭ হাজার ৩০০ কেজি সিলগালা (লাল রংয়ের) কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে।

নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় বিভিন্ন স্তরে ৭ লাখ ১৮ হাজার নির্বাচন কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা থেকে শতকরা ১০ ভাগ বেশি নিয়োগের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। নির্বাচনে কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তার পাশাপাশি সরকারের বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে এসব কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। এছাড়া দুই লাখ ৬৭ হাজার ৮০০ কর্মকর্তা প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং এবং চার লাখ ৪৬ হাজার ৭৩৭ পোলিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হবে। সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে এসব কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও আচরণবিধি লংঘনকারীদের সাজা দিতে ৩০০ সংসদীয় আসনে ৬০০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্টে ট ও নির্বাচনী তদন্ত কাজে ১৬০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনায় দক্ষতা, সম্ভাব্য সমস্যা বা বাধা মোকাবেলায় কৌশল অবলম্বনে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হবে। প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩ কোটি ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার ৯৬০ টাকা। তফসিল ঘোষণার ৭০ দিন আগ থেকে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ শুরু হবে।