নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার যাত্রা শুরু : ৬ মন্ত্রী ও ২ প্রতিমন্ত্রীর শপথ

শপথ নেয়া মন্ত্রীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২ জাতীয় পার্টির ৫ এবং ওয়ার্কাস পার্টির ১ জন

 

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনকালীন সরকারের নামে নতুন মোড়কে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হলো। গতকাল সোমবার শপথ নেয়া মন্ত্রীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২ জন, জাতীয় পার্টির ৫ জন এবং ওয়ার্কাস পার্টির ১ জন রয়েছেন। যদিও আগের মন্ত্রিসভা বহাল না বাতিল কোনোকিছুই এখনও স্পষ্ট নয়। বলা হচ্ছে আগের মন্ত্রিসভা থেকে দপ্তর পুনর্বণ্টন ও কিছু উপদেষ্টা এবং মন্ত্রী বাদ যেতে পারেন। পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভাকে মুখে সর্বদলীয় সরকার বলা হলেও আগের মন্ত্রিসভায় থাকা জাসদের এক সদস্যসহ মন্ত্রিসভার আকার দাঁড়ায় চারদলের। এতে শেষ পর্যন্ত নানা মুন্সিয়ানায় এরশাদ মহাজোটের শরিক হয়েও যোগ দিয়েছেন। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ই সরকারের এ নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার পুনর্গঠন হলো। শক্তিশালী দেশের এ কূটনীতিক যেখানে সঙ্কট সমাধানে উভয় দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্টানের তাগিদ দিয়েছেন। ঠিক সে সময়ই ঘটা করে এ মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কটের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হোঁচট- রাজনীতি সচেতনমহলে এমনটাই বলাবলি হচ্ছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, নতুন মন্ত্রিসভাকে সর্বদলীয় সরকার বলা যায় না। আবার একে নির্বাচনকালীন সরকারও বলা যায় না। গঠিত এ সরকারের বাইরে রয়েছে বিএনপি।

অন্যদিকে এটি কোনভাবেই নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ নয়। ওদিকে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতরাতেই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, জাতীয় সংসদে আটটি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। আর এ সরকারে প্রতিনিধিত্ব করছে চার দল। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বড়জোর এ সরকারকে বহুদলীয় বা চারদলীয় সরকার বলতে রাজি আছেন। তারা বলেছেন, এ সরকারকে সর্বদলীয় বললে এটা হবে সত্যের অপলাপ। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিলেও মূল সঙ্কটের সমাধান হবে না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভাকে একটু বেশি করে বললে বহুদলীয় সরকার বলা যায়। এতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পথ সুগম হয়েছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতা, চিরকাল রাজনীতি যাদের পেশা তাদেরই মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়েছে। বিশিষ্টজনরা এটা অনিশ্চিত আশাবাদ- এমনটাই বলেছেন। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই থাকছেন। আর নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপারদের বদলির ক্ষমতা রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছেই থাকবে।

৬ নতুন মন্ত্রী, ২ প্রতিমন্ত্রী: পদত্যাগ নাটকের পর মহাজোটের নয়া মন্ত্রিসভার আট সদস্য শপথ নিয়েছেন। গতকাল সোমবার বঙ্গভবনের দরবার হলে তাদের শপথ বাক্য পাঠ করান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। বিকেল তিনটা ৫ মিনিটে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমীন হাওলাদার, দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এইচএম এরশাদের সহধর্মিণী রওশন এরশাদ। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন যুগান্তর সম্পাদক জাতীয়পার্টির সালমা ইসলাম এমপি ও মুজিবুল হক চুন্নু। জাতীয়পার্টি নেতা জিয়াউদ্দিন বাবলুকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উপস্থিত ছিলেন। তবে তাদের বেশ বিমর্ষ দেখা যাচ্ছিলো। শপথ অনুষ্ঠান শেষে তারা এক সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন। গত পাঁচ বছর মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ এবার মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। এর আগে গত বছর তোফায়েল আহমেদকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি যোগ দেননি। সে সময় মন্ত্রী হতে রাজি না হওয়ায় রাশেদ খান মেননও এবার মন্ত্রী হলেন। নতুন মন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভূঁইঞা। শপথের পর নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা শপথনামায় সই করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ-ও কুশল বিনিময় করেন নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সাথে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী একসাথে দরবার হলে আসেন। সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং এরশাদের ভাই ও বাণিজ্য মন্ত্রী জিএম কাদের এবং আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কয়েকজন সংসদ সদস্যও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

শপথ নেয়ার পর নতুন প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু ও অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পা ছুঁয়ে সালাম করেন। ২৫ মিনিটের এ শপথ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো। তবে অন্যদের মধ্যে রুহুল আমিন হাওলাদার ছিলেন অনেকটা বিমর্ষ। রওশন এরশাদ শপথ নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর সাথে করমর্দন করেন। এক সময়ের ফার্স্ট লেডি রওশন এরশাদ ১৯৯৬ সালে ময়মনসিংহ, ২০০১ সালে গাইবান্ধা ও ২০০৯ সালে উপনির্বাচন করে রংপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তার দলের চেয়ারম্যান এরশাদের সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আর রুহুল আমিন হাওলাদার বরিশালের সংসদ সদস্য। মুজিবুল হক চুন্নু ১৯৮৭-৮৮ সালে এরশাদ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সালমা ইসলাম যমুনা গ্রুপের মালিক নুরুল ইসলাম বাবুলের স্ত্রী এবং দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক ও প্রকাশক। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়া হয়নি নির্বাচিত সংসদ সদস্য না হওয়ার কারণে।

নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিই কাজ: মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিই তাদের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। শপথ নেয়ার পর গণমাধ্যমের কাছে তারা এ মন্তব্য করেন। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করাই এ মন্ত্রিসভার দায়িত্ব। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্যই আমরা শপথ নিয়েছি। মূলত সুষ্ঠু নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। তার পরিবেশ তৈরি করাই আমাদের দায়িত্ব। আমির হোসেন আমু বলেন, আমরা নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করবো। এ মন্ত্রিসভাকে সর্বদলীয় বলা যায় কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, একাধিক দল থাকলে তাকে সর্বদলীয় সরকার বলা যায়। কোনো কারণে নির্বাচন না হলে কি হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা সংবিধানে বলা আছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই আমাদের প্রথম কাজ। সেটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় বটে। তবে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে আমরা সফল হবো। তিনি বলেন, আগের মন্ত্রিসভায় আমি কেন ছিলাম না তা আগেই স্পষ্ট করেছি। কিন্তু এখন গণতন্ত্রের সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য এ মন্ত্রিসভায় আমি অংশ নিয়েছি। মহাজোটের আরেক মন্ত্রী জাপা নেতা জিএম কাদের বলেন, আমি তো আগে থেকেই মন্ত্রী। আমরা মন্ত্রিসভায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বেশ কয়েকজন মন্ত্রী রয়েছি। ফলে, নির্বাচনের সময় কোনো রকমের প্রভাব সৃষ্টি করলে তা প্রতিহতের চেষ্টা করতে পারবো। প্রতিমন্ত্রী পদে শপথ নেয়া মুজিবুল হক চুন্নু-ও বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্যই আমরা মন্ত্রিপরিষদে অংশ নিয়েছি।