নির্বাক-মুহ্যমান খালেদা জিয়া

স্টাফ রিপোর্টার: ছেলে হারানোর শোকে নির্বাক মুহ্যমান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকটা নিথর হয়ে পড়েছেন তিনি। নিজের ঘরে কবাট বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ একান্তে অশ্রুপাত করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন।
৩ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করছেন।
গুলশান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, শনিবার বেলা আড়াইটার সময় খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ এসকান্দরের স্ত্রী নাসরিন সাঈদ ও শামীম এসকান্দরের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা খালেদা জিয়াকে তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ দেন। তারা বলেছেন, দু ভাইয়ের স্ত্রীদের কাছ থেকে ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে নির্বাক হয়ে যান খালেদা জিয়া। পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারেননি। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ওনার ঘরের দরজা বন্ধ। কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, অবরোধের মধ্যে ৩৬ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা বিএনপি জোটের পক্ষ থেকে দেয়ার পর শনিবার দুপুরে গুলশানে নিজের কার্যালয়ে বসে সংবাদপত্র পড়ছিলেন খালেদা জিয়া। এই সময়ই আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর নিয়ে দু ভাইয়ের স্ত্রী নাসরিন সাঈদ ও কানিজ ফাতেমা ওই কার্যালয়ের দোতলায় ওঠেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দু ভাইয়ের স্ত্রীর কাছ থেকে ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে এক রকম নির্বাক হয়ে যান খালেদা জিয়া। প্রথমে তিনি কোনো কথা বলতে পারেননি। পরে ঘরের দরজা বন্ধ করে তিনি দীর্ঘক্ষণ কান্নাকাটি করেন। এরপর লন্ডন থেকে তারেক রহমানের টেলিফোন আসে খালেদা জিয়ার কাছে।

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত শনিবার দুপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে মারা যান। তার বয়স হয়েছিলো ৪৫ বছর। স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথি, দু মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে নিয়ে কুয়ালালামপুরে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকছিলেন আরাফাত।

জরুরি অবস্থার সময় গ্রেফতার হয়ে এক বছর কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন আরাফাত। সেখান থেকে তিনি মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। অন্যদিকে মুদ্রা পাচার মামলায় বাংলাদেশের আদালতে ২০১১ সালে তার ৬ বছর কারাদণ্ড হয়; তবে বিএনপির দাবি, এ মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

২০১৩ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ে খালেদা জিয়া ব্যাংককে যাত্রাবিরতি দিয়ে ছোট ছেলেকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিলো মায়ের সাথে তার শেষ সাক্ষাৎ। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এবং রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই ছেলেকে ঘিরেই ছিল খালেদার জীবনযাপন। পরে রাজনীতিতে আসেন খালেদা, এক সময় আসেন তারেকও। কোকো সেভাবে কোনো পদের অধিকারী না হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচিত হন নানাভাবে।

ওয়ান-ইলেভেনের সময়টিতে ভেঙে যায় জিয়া-পরিবার। তিন সদস্য তিন দেশে বসবাস করেন পরবর্তী সময়ে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশে, তারেক লন্ডনে, কোকো মালয়েশিয়ায়। একে অন্যের সাথে দেখা-সাক্ষাতে গোপনীয়তা বজায় রাখেন তারা বিভিন্ন সময়। তারেক যতোটা মায়ের দেখা পাচ্ছিলেন, কোকো সেভাবে পাচ্ছিলেন না। তাকে মিডিয়া ও লোকচক্ষুর আড়ালেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে হচ্ছিলো।

মালয়েশিয়ার মন্ত্রীপাড়ায় বাসরত কোকোর নিরাপত্তার বিষয়টি জোরদার করেন তারেক। আদরের ছোট ভাইয়ের অবস্থান যেন প্রকাশ না হয়ে পড়ে সেদিকে তার নজর ছিলো সবসময়। ভাইকে সময় দিতে তারেক প্রায়ই চিকিৎসার অজুহাতে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে যেতেন।

তারেক ছোটবেলা থেকে কোকোর নানা আবদার পূরণ করে আসছিলেন বলে তাদের কাছের মানুষদের কাছ থেকে জানা যায়। মায়ের ব্যস্ততায় ছোটভাইকে সময় দিতেন তিনি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির সংবাদেই চোখ ছিলো সবার। এর মাঝে হঠাৎ কোকোর মৃত্যু সংবাদে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে সবদিকে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমের মনোযোগ ও আলোচনা এখন জিয়া পরিবারের দুঃসংবাদে। আরাফাতের মৃত্যুর সংবাদের পর গুলশানে খালেদার কার্যালয়ে ছুটে যান নিকটাত্মীয়রা। আরাফাতের শাশুড়িসহ তাদের পরিবারের সদস্যরাও যান সেখানে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম যান দলীয় চেয়ারপারসনকে সান্ত্বনা জানাতে। বিএনপি নেতা গিয়াস কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাৎ কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ ও তার স্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সদরুল আমিন, সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস যান সেখানে।