নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ সাত খুন মামলার রায়

নূর হোসেনতারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল

স্টাফ রিপোর্টার: নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। জজ আদালতে যে ২৬ আসামিকে দেয়া মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো, তাদের মধ্যে ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে, যা না দিলে আরও দুই বছরের সাজা ভোগ করতে হবে। নিম্ন আদালতে নয়জনকে দেয়া বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডের রায়ে কোনো পরিবর্তন আসেনি হাই কোর্টে। আসামিদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে। তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেওয়ার ওই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। ওই হত্যাকাণ্ডে এলিট বাহিনী র‌্যাবের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়েছিলো। হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১৫ আসামির মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগেরসহ সভাপতি।

সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া সামরিক বাহিনীর সাবেক তিন কর্মকর্তার মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ওই হত্যাকাণ্ডের সময় র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। র‌্যাবের ক্যাম্প কমান্ডার আরিফ হোসেন ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর। আর মাসুদ রানা ছিলেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্য। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সাথে আসামি নূর হোসেনের দ্বন্দ্বের জেরেই ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সাত খুনের ঘটনা ঘটে।

নূর হোসেনকে ওই হত্যাকাণ্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে বর্ণনা করে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, তার সাথে তিন র‌্যাব কর্মকর্তার অবৈধ অর্থিক লেনদেন হয়েছিলো। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “কিছু উচ্ছৃঙ্খল র‌্যাব সদস্যের কারণে এ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না। তাদের সন্ত্রাসবিরোধী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ধূলিস্যাৎ হতে পারে না। কিন্তু এই বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অপরাধবৃত্তি মানব সভ্যতায় আতঙ্কজনক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা এতটাই পাশবিকতা দেখিয়েছে, যা ছিলো নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ প্রকাশ।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, আসামিরা যে ধরনের অপকর্ম করেছে সেসব অপকর্মের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টেও এ রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত দণ্ড কার্যকর হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী এস আর এম লুৎফর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করব। রায়ের কপি পাওয়ার আগেই আমরা সিএমপি (আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল) করব। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আরেক আসামি তারেক সাঈদ ও সাজা কমে যাবজ্জীবন হওয়া রহম  আলীর আইনজীবী একেএম ফজলুল হক খান ফরিদও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলেছেন। আর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এই রায়কে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, তিনি ‘স্বস্তি’ পাচ্ছেন। ১১ জনের সাজা কমানোর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি-না, পুরো রায় পড়ার পর সে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।

হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ: এক দফা পেছানোর পর মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় হাই কোর্ট এ মামলার রায় পড়া শুরু করে। প্রথমে সাংবাদিকদের এজলাস কক্ষে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও পরে দশজন সাংবাদিককে ঢোকার সুযোগ দেয়া হয়। দুপুরে ঘণ্টাখানেক বিরতি দিয়ে বিকেল সাড়ে ৪টায় রায় পড়া শেষ করে আদালত। সেখানে ১৫ আসামির ফাঁসির রায় বহাল থাকে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, র‌্যাব রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বিশেষ বাহিনী। তাদের দায়িত্ব হলো জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু এ বাহিনীর কিছু সদস্য নৃসংশ হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পরে অপরাধ ঘটিয়েছে। ফলে তাদের বিচার হয়েছে।

সাত খুন: ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ঢাকার ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে অপহরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরকে।

ওই ঘটনা দেখে ফেলায় নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহৃত হন। তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে মেলে ছয়জনের লাশ। ১ মে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশও নদীতে ভেসে ওঠে। প্রত্যেকের পেটে ছিলো আঘাতের চিহ্ন; প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো। লাশ উদ্ধারের পর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন, যার তদন্ত চলে একসাথে। দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল।