নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়কের ফোনালাপ : তোলপাড়

মাহমুদুর রহমান মান্নাকে দেখা মাত্রই গণপিটুনির ঘোষণা : মন্ত্রিসভার বৈঠকে গ্রেফতার দাবি

 

ঢাকা অফিস: আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার দুটি টেলিফোন কথোপকথন ফাঁসের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। জেনারেলদের সাথে বৈঠকে আগ্রহী মান্না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চান মান্না শিরোনামে দুটি অডিওবার্তা ছড়িয়ে পড়ার পর বেকায়দায় তিনি। গতকাল তার পক্ষে গণমিছিল কর্মসূচি তড়িঘড়ি স্থগিত করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার তিনি সংবাদসম্মেলনে সপক্ষে বক্তব্য দেবেন বলেও তার তরফে জানানো হয়েছে। অপরদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে পাড়ার চায়ের দোকান- সর্বত্রই চলছে মান্নার ফোনালাপ নিয়েই তর্ক-বিতর্ক। ছাত্রলীগ তাকে যেখানেই দেখা যাবে সেখানেই গনধোলায়ের ঘোষণা দিয়েছে।

অবশ্য মান্না বলেছেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা এবং একজন সেনা কর্মকর্তার সাথে কথোপকথনের অংশে তার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, বিষয়টি স্রেফ একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। কথোপকথন ফাঁস হওয়ায় তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে আপাতত আÍগোপনে থাকার পথ বেছে নিয়েছেন। মাহমুদুর রহমান মান্নার এ ফোনালাপকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তারা অবিলম্বে তাকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলত সাজা দেয়ার দাবি করেন।

ফাঁস হওয়া বক্তব্যের কারণে সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও অফিসার্স ফেডারেশন তাকে গ্রেফতারের দাবি জানান। একই সাথে তারা মান্নার শিক্ষাগত সব সনদ বাতিলের দাবি করেন। এদিন সন্ধ্যায় বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে তুলোধুনো করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে মান্নাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে। একই সাথে তাকে দেখা মাত্র গণধোলাই দেয়ার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়। নাগরিক ঐক্যের পূর্বনির্ধারতি কর্মসূচি সোমবার শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়। কর্মসূচি উপলক্ষে দলের নেতাকর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমবেত হলে পুলিশ পাহারার মধ্যেই নেতাদের ছাড়াই কর্মীরা মিছিল করেন। শান্তি ও সংলাপের দাবিতে সোমবার বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে গণমিছিল করার কর্মসূচি ছিল নাগরিক ঐক্যের।

সেনা হস্তক্ষেপ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার কথোপকথন ফাঁস হওয়ার ঘটনাকে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকেই। তারা অবিলম্বে মান্নাকে গ্রেফতারের দাবি তোলেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্যরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ তার আগের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও কথা বলেন। তারা বলেন, মাহমুদুর রহমান মান্না একেক সময় একেক দল করেছেন। কখনও জাসদ, কখনও বাসদ, এরপর আওয়ামী লীগ- এভাবে দল বদল করেছেন। তার কোনো চরিত্র নেই। এ নিয়ে হাস্যরসও হয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার বড় ভাই জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ করতেন তার বড় ভাই। ঘটনাচক্রে হয়তো মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে মান্নার সাম্প্রতিক তৎপরতার পেছনে জামায়াতের যোগসূত্র আছে।

মন্ত্রীদের ক্ষোভের কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কথোপকথনের যেসব তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে, তারা একটা ষড়যন্ত্র নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। এখন আপনারাই চিন্তা করেন, ভেবে দেখেন, কী করা যায়? ক্যাবিনেটের আলোচনা সবই তো গণমাধ্যমে চলে যায়।

গতকাল সোমবার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিতে বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বলে নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ড. কামাল হোসেন কর্মসূচিতে আসেননি। এছাড়া মাহমুদুর রহমান মান্না উপস্থিত থাকতে না পারায় শেষ মুহূর্তে পূর্বঘোষিত গণমিছিল করা থেকে সরে আসেন নাগরিক ঐক্যের নেতাকর্মী এবং সমর্থকরা। নাগরিক ঐক্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিনি (মাহমুদুর রহমান মান্না) অসুস্থ। তাই কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারেননি। নাগরিক ঐক্যের এ কর্মসূচিকে ঘিরে পুলিশ দিনভর বেশ তৎপর ছিল। তোপখানা রোডের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও জাতীয় প্রেস ক্লাব সর্বত্র অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাগরিক ঐক্যের একজন শীর্ষ নেতা জানান, গ্রেফতার হতে পারেন- এমন ভাবনা থেকেই মূলত কর্মসূচিতে অংশ নেননি মাহমুদুর রহমান মান্না। এদিকে মাহমুদুর রহমান মান্নার কথোপকথনের বিষয়টি নিয়ে সরকার আরেকটি জজ মিয়া নাটক সাজানোর চেষ্টা করছে বলে দাবি করেছেন নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা এসএম আকরাম হোসেন। পূর্বঘোষিত গণমিছিলের কর্মসূচি স্থগিত করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। এসএম আকরাম বলেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার নামে যে অডিও টেপ ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছে তা সত্য নয়। মান্না এ ধরনের কথা বলতে পারে না। জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই এটা করা হয়েছে।

ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপের কথোপকথনে সংলাপ না করলে প্রয়োজনে সেনা হস্তক্ষেপে ভূমিকা রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন মাহমুদুর রহমান মান্না। অজ্ঞাত এক ব্যক্তির কাছে টেলিফোন করে তিনি এ আগ্রহ প্রকাশ করেন। অজ্ঞাত পরিচয়ের ওই ব্যক্তি নিজেকে এক-এগারোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বলে দাবি করেন। অডিও ক্লিপের কথোপকথনে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ দু কর্মকর্তার সাথে বৈঠকের পরিকল্পনার কথাও প্রকাশিত হয়।

সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ দু কর্মকর্তার সাথে বৈঠকের পরিকল্পনা সম্পর্কে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, একজন নাগরিক হিসেবে সবার সাথেই আমার আলোচনার সুযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা আমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হলে, আমি তাদের সাথে কথা বলবো কি-না সে সম্পর্কে জানতে চাইলে, আমি বলেছি- হ্যাঁ কথা বলতে রাজি আছি। আমি রাজনীতি করি। তাই সবার সাথেই আমাকে কথা বলতে হয়। এটা থেকে এক-এগারো বা সামরিক কু’এর ষড়যন্ত্রের আবিষ্কার হয় কীভাবে? যেখানে এ রকম কোনো বৈঠকই হয়নি। তাই এ নিয়ে অপব্যাখ্যার কোনো সুযোগ নেই।

বেশ কিছুদিন ধরে দেশের বাইরে অবস্থানরত বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সাথে কথোপকথনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ চাওয়ার বিষয় নিয়েও প্রশ্নের জবাব দেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপে মাহমুদুর রহমান মান্না সাদেক হোসেন খোকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কথা বলতে শোনা গেছে।

বিএনপি-জামায়াত জোটের চলমান আন্দোলন নিয়ে দু নেতার দীর্ঘ কথোপকথন রয়েছে ওই টেপে। এ বিষয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সাদেক হোসেন খোকার সাথে আমার মাঝে মধ্যেই কথা হয়। তার সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিনিই আমাকে ফোন করেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানতে চান। আমিও আমার মতামত তার সাথে শেয়ার করি। লাশ ফেলার প্রসঙ্গটি অবান্তর। তিনি আরও বলেন, সাদেক হোসেন খোকার সাথে আলাপচারিতায় অনেক প্রসঙ্গই এসেছে। আমি তাকে বলেছি, গণতন্ত্রের দাবিতে আমি আন্দোলন সমর্থন করি। সহিংসতা সমর্থন করি না। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যাপকভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা উচিত। সহিংসতা বর্জন করা উচিত।

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমি সাদেক হোসেন খোকাকে বলেছি আন্দোলন-সংগ্রামে এখনও ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত করতে হবে। এটা করতে গিয়ে যদি পুলিশ বা সন্ত্রাসী হামলায় দু চারজনের জীবনও যায় কিছু করার নেই। তিনি বলেন, এমনিতেই তো প্রতিদিন মানুষ মরছে। কেউ পুড়িয়ে মানুষ মারছে। কেউ ক্রসফায়ারের নামে মানুষ মারছে। রোববার রাতেও ক্রসফায়ারের নামে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। আমার এ বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বোঝানোর চেষ্টা চলছে যে, যেন আমিই লাশ চাই। আমি তাকে (সাদেক হোসেন খোকা) লাশ ফেলতে বলছি।

এক-এগারো পরবর্তী সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগের সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিতি পান আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মান্না। নির্বাচনের পর দলীয় পদ হারিয়ে গত মহাজোট সরকারের সময়ে তিনি নাগরিক ঐক্য নামে একটি সামাজিক সংগঠন গঠন করেন। সম্প্রতি তিনি ড. কামাল হোসেনকে সাথে নিয়ে রাজনীতিতে বিকল্প শক্তির উত্থানে গণফোরাম, সিপিবি, বাসদ, জেএসডিসহ সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে যুগপৎভাবে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দু প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সংলাপে বসাতে সুশীল সমাজের উদ্যোগের পেছনেও তার সম্পৃক্ততা রয়েছে।