নতুন মন্ত্রিসভার শপথ আজ : জাতীয় পার্টি যুক্ত হলে বিতর্কের মুখে পড়বে মন্ত্রিসভা

স্টাফ রিপোর্টার: আটচল্লিশ সদস্যের মন্ত্রিসভা আজ শপথ নিতে যাচ্ছে। বিকেলে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের পরপরই মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে দফতর বণ্টন করা হবে। তবে শপথ নিতে যাওয়া এ মন্ত্রিসভায় প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি থেকে কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করায় তা শুরুতেই বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, প্রধান বিরোধীদল থেকে সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে একদিকে সরকার যেমন বিতর্কিত হবে, তেমনি জাতীয় সংসদও কার্যত বিরোধী দলহীন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাদের যুক্তিসঙ্গত অভিমতও ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া এ ধরনের সরকার ও বিরোধীদলের কাঠামো আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। ইতোমধ্যে সরকারি দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নীতিনির্ধারকও তাদের বক্তৃতায় বলেছেন, প্রধান বিরোধীদল থেকে মন্ত্রিসভায় কাউকে স্থান দেয়া হলে তা সংবিধানপরিপন্থি হবে। এমন কী প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদও মন্ত্রিসভায় যাওয়ার ঘোর বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন।

জানা গেছে, সংসদে প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত ছাড়াই দলের কয়েকজন মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও এতে সায় দিয়ে তাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তবে দলীয় সূত্র জানিয়েছে, যারা প্রধান বিরোধী দলের সদস্য হয়েও মন্ত্রিসভায় যোগ দিচ্ছেন তাদের দিয়ে সরকারের কোনো লাভ হবে না। তাদের নিজ দলের মধ্যে যেমন ভালো অবস্থান নেই, তেমনি নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকাতেও সুসংহত জনসমর্থন নেই। নির্বাচনী এলাকা থেকে তারা অনেক আগেই এক রকম জনবিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। যাদের সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও তেমনি কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির কর্ণধার এইচএম এরশাদ যেখানে মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণের ঘোর বিরোধী সেখানে এভাবে প্রধান বিরোধীদল থেকে মন্ত্রী করা হলে তা খুবই নিন্দনীয় ও বিতর্কের সৃষ্টি করবে। ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় ও টিভি টকশোতে সুশীল সমাজের অনেকেই এ ধরনের সরকার ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন।

গতকাল শনিবার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটি অনুষ্ঠানে তার সুস্পষ্ট বক্তব্যে জানিয়েছেন, প্রধান বিরোধীদল থেকে মন্ত্রিসভায় কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে যেমন সাংঘর্ষিক হবে, তেমনি সংবিধানসম্মত হবে না।

বিকেল সাড়ে ৩টায় বঙ্গভবনে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন শেখ হাসিনা। তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর পর তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ পড়ানো হবে। জানা গেছে, নতুন মন্ত্রিসভা গঠনে নানা হিসাব-নিকাশ করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত মেয়াদের মতো এবারের মন্ত্রিসভায়ও নতুনদের প্রাধান্য থাকছে। গতবারের মন্ত্রীদের বেশির ভাগই বাদ পড়ছেন। আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতাদের সাথে থাকছেন তরুণ এমপিরাও। এদের মধ্যে ক্লিন ইমেজধারী কয়েকজন এমপি রয়েছেন। দলটির নীতিনির্ধারণী মহলের প্রত্যাশা নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে একটি শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠনের।

গণভবন সূত্র জানিয়েছে, নতুন মন্ত্রিসভায় কারা থাকছেন, সে রকম একটি তালিকা শুক্রবার রাতে চূড়ান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত ১২-১৫ জনের এ তালিকা শনিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেয়া হয়। বাকিদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তালিকা শনিবার রাতেই চূড়ান্ত হওয়ার কথা। দলের সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করছেন। মতামত দিলেও অনেক সিনিয়র নেতাই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কারা মন্ত্রিসভায় থাকছেন। ফলে মন্ত্রিত্ব প্রত্যাশীরা রয়েছেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। তারা নানাভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদবির করছেন। তবে নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আগের ব্যক্তিরাই থাকছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলাপকালে তারা এমন আভাস পেয়েছেন। বিশেষ করে অর্থ, আইন, কৃষি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পুরনোরাই বহাল থাকতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী এবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কোনো সিনিয়র নেতাকে দিতে চান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নাম সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে বলে দলের একজন নীতিনির্ধারক জানিয়েছেন। তবে তিনি একথাও মনে রাখতে বলেছেন, রেওয়াজ অনুযায়ী দলের সাধারণ সম্পাদকরা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে থাকেন।

ওই সূত্রটি জানিয়েছে, নতুন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। স্বাস্থ্যগত কারণে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের কেউ কেউ অনাগ্রহী ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত এ যুক্তি নাও টিকতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। দলের সিনিয়র নেতা আবুল মাল আবদুল মুহিত, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, ওবায়দুল কাদের, নুরুল ইসলাম নাহিদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শাজাহান খান, আকম মোজাম্মেল হক, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মুজিবুল হক, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু নতুন মন্ত্রিসভায় থাকছেন বলে জানা গেছে। সংসদ উপনেতা হিসেবে মতিয়া চৌধুরীর নাম আলোচনায় রয়েছে। মতিয়া চৌধুরী রাজি হলে তাকে এ পদ দেয়া হতে পারে। নতুনদের ক্ষেত্রে আফম বাহাউদ্দীন নাছিমের বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। তিনি কৃষি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে পারেন। দলের সাবেক দু সাংগঠনিক সম্পাদক বগুড়ার এমপি কৃষিবিদ আবদুল মান্নান ও ফরিদপুরের এমপি আবদুর রহমান, নওগাঁর এমপি ইসরাফিল আলম, রাজশাহীর এমপি শাহরিয়ার আলম, ঢাকার কেরানীগঞ্জের এমপি নসরুল হামিদ বিপু, দিনাজপুরের এমপি ইকবালুর রহীম, যশোরের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ ও ভোলার জ্যাকব এবং নাটোরের এমপি জুনায়েদ আহমেদ পলকের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

আওয়ামী লীগের একটি নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক দু প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার ও মন্নুজান সুফিয়ান এবং সাবেক হুইপ সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। তবে দুর্নীতিসহ নানা কারণে বিতর্কিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নতুন মন্ত্রিসভায় না নেয়ার জন্য দলে এবং দলের বাইরে থেকে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। যেসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গত পাঁচ বছরে অস্বাভাবিক উপায়ে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের নতুন মন্ত্রিসভার বাইরে রাখার জন্য শক্ত অবস্থান নিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এসব দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।

গণভবন সূত্র জানিয়েছে, দলের জন্য সময় দিতে পারে সে বিবেচনায় আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদকদের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী না করার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপরও যুগ্মসাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানককে মন্ত্রী করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী গ্রুপ। সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীর কবির নানককে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে অপর যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলমও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতে পারেন।