দ্বিতীয় বিশ্ব বাঘ পর্যালোচনা সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী

বাঘ না থাকলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব থাকবে না

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাঘ না থাকলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব থাকবে না। আর জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির প্রবেশ প্রভৃতি কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বাঘসহ অন্যান্য জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

গতকাল রোববার দ্বিতীয় বিশ্ব বাঘ পর্যালোচনা (স্টকটেকিং) সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সকালে প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বন বিভাগ আয়োজিত তিনদিনব্যাপি এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবেশ ও বন উপ-মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজিবুর রহমান, বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশ অফিসের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. জোহানেস জাট। সম্মানিত অতিথি ছিলেন গ্লোবাল টাইগার ফোরামের মহাসচিব ড. রাজেশ গোপাল। এ সম্মেলনের লক্ষ্য নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. এন্ড্রে ভি. কুশলিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুন্দরবনকে রক্ষা করে বাঘ। আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন। তাই বাঘ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার। তিনি বলেন, শুধু বাঘ রক্ষাই নয়, প্রাণী বৈচিত্র্যের বিপুল আধার হিসেবে সুন্দরবনকে রক্ষা করা জরুরি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীব-পরিবেশের এক অনন্য নিদর্শন এই সুন্দরবন। এই বনভূমির উপর প্রায় ১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ইত্যাদি বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাঘ রয়েছে এমন সব দেশের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, আসুন সকলে মিলে বাঘ বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই। প্রধানমন্ত্রী বাঘ রক্ষায় তার সরকারের সব ধরনেরর সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ২০০০ সালে গ্লোবাল টাইগার ফোরামের প্রথম সাধারণ সম্মেলনও ঢাকাতেই হয়েছিল। বিগত ১৪ বছরে বাঘ সংরক্ষণের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্ব ‘একটি পর্যায়ে’ পৌঁছেছে। এ পর্যন্ত নেয়া কর্মসূচির মূল্যায়ন ও ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত একশ বছরে বাঘের সংখ্যা এক লাখ থেকে হ্রাস পেয়ে তিন হাজার ৭শতে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে বিগত দু বছরে বাংলাদেশে কোনো বাঘ হত্যা হয়নি। আর এর আগে বছরে মানুষের হাতে গড়ে ৩-৪টি বাঘের মৃত্যু হতো। বাঘের আক্রমণে মানুষ মৃত্যুর সংখ্যাও ২৫-৩০ জন থেকে কমে মাত্র চারজনে এসে দাঁড়িয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, বনভূমি ধ্বংস এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাপে বাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থল দিন দিন কমে আসছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে বাঘের বৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে দ্বিতীয় বিশ্ব বাঘ স্টকটেকিং সম্মেলন তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। বাঘ চিরকাল বেঁচে থাকবে। সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় জনসাধারণের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বন্যপ্রাণীর আক্রমণে নিহত বা আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। ওয়াইল্ড টিম ও স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে একটি টাইগার রেসপন্স টিম এবং সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করেছি। ফলে লোকালয়ে বাঘ আসা মাত্র খবরাখবর আদান-প্রদান ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজতর হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় জনসাধারণকে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সুন্দরবনের আশপাশের উপজেলায় ৪টি সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া বন ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং জোরদার ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণসহ সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভারতের সাথে একটি প্রোটোকল ও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, এশিয়ার প্রকৃতি ও সংস্কৃতিতে বাঘ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।  বাঘ অধ্যুষিত অনেক দেশেই এটি জাতীয় প্রাণী হিসাবে ঘোষিত এবং ‘শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক’। বাঘ সংরক্ষণে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ২০১০ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সম্মেলনে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার ঘোষণা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশ্বনেতারা ঐকমত্যে পৌঁছান। এরপর ২০১২ সালের আক্টোবরে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে বাঘ অধ্যুষিত দেশগুলোর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বাঘ সংরক্ষণে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, আবাসস্থল সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নয় দফা কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। পরে থিম্পু সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে চীনের কুনমিংয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়, যেখানে বাঘের আন্তঃসীমান্ত আবাসস্থল রক্ষা ও বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা বন্ধে একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। থিম্পুতে নেয়া ৯ দফা কর্মপরিকল্পনার আলোকে ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করে ঢাকায় একটি নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ প্রণয়নসহ বাঘ রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, জামিন অযোগ্য এ আইনে বাঘ শিকারি বা হত্যাকারীর ২ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনসহ সারাদেশে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো অপারেশন ফর ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন’ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। বন বিভাগের ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট বন্যপ্রাণী পাচার, অবৈধ বিক্রি ও প্রদর্শন রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে। অসুস্থ বাঘের সেবা দিতে খুলনায় একটি ‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’ স্থাপন করা হচ্ছে। বন বিভাগ বাঘের সাইন্টিফিক মনিটরিং ও জরিপের জন্য গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে ওয়াইল্ডলাইফ ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া’র সহায়তায় পরীক্ষামূলকভাবে ক্যাপচার ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ জরিপ শেষ হলে সুন্দরবনে বাঘের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হবে। আগামী ডিসেম্বরে জরিপের ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুরক্ষা ও বংশ বিস্তারে শেখ হাসিনার সরকার সবসময় কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রের লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সমু্রদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি–এসব সুন্দরবনকে যেমন হুমকির মুখে ফেলেছে একইসঙ্গে বাঘের অস্তিত্বও বিপন্ন করে তুলেছে। এসব বাধাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েই আমরা বাঘ রক্ষায় সচেষ্ট এবং কার্যকর উদ্যোগ পরিচালনা করে চলেছি।

পরিবেশ ও বন উপ-মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব বলেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঘ সংরক্ষণ করতে হবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এ কাজ কঠিন হলেও সরকার তা সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর।

উদ্বোধন শেষে রাশিয়ান ফেডারেশন ডেলিগেশনের প্রধান আমির খান আমির খানভ ও গ্লোবাল টাইগার ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক কেশব ভার্মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দেন। বাঘ সংরক্ষণে মুখ্য ভূমিকা পালনের জন্য তাকে এ প্রতীকী প্রশংসাপত্র দেয়া হয়। এছাড়া সম্মেলনে আগত গবেষকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ অন্যান্য অতিথির সঙ্গে গ্রুপ ফটোসেশনে অংশ নেন।

সবশেষে স্পন্দনের শিল্পীরা নাচের মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতা, বাঘের বিপন্নতা রোধ ও বন রক্ষার বিষয়টিকে হূদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দর্শক সারিতে বসে এ পরিবেশনা উপভোগ করেন। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এমপি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমুদ্র উপকূলবর্তী ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিশ্বের সর্ববৃহত্ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে। বন বিভাগের আয়োজনে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে বাঘ সংরক্ষণে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গতকাল থেকে শুরু হওয়া তিনদিনের এ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য হলো গ্লোবাল টাইগার রিকভারি প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের হালনাগাদ অগ্রযাত্রা জানা, বাঘ সংরক্ষণের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা, প্রয়োজনীয় সম্পদের যোগান ও চাহিদার পার্থক্য নিরূপণ, বাঘ সংরক্ষণে বৈশ্বিক সহযোগিতা জোরদারকরণ ও প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের জন্য বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং ‘ঢাকা ঘোষণা’র মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা।