দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লুটপাট হচ্ছে তহবিল

সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পরিচালকসহ ২৫০ চিকিত্সকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন

স্টাফ রিপোর্টার: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিত্সকদের কর্মস্থলে থাকা বাধ্যতামূলক এবং অনুপস্থিত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা। এছাড়া সেখানে চিকিত্সা সেবায় কোনো ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেলে একই ব্যবস্থা। কিন্তু শীর্ষ প্রশাসনের সেই নির্দেশনা স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসন তোয়াক্কাই করে না। সাম্প্রতিককালে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ১৭ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ে। এ নিয়ে শুধু তদন্ত হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিত্সাসেবা কার্যক্রম, চিকিত্সকদের উপস্থিতি, ব্যবস্থাপনা, ওষুধপত্র সরবরাহ ও স্বাস্থ্য খাতের টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি-না, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জন কর্তৃক তা নিয়মিত মনিটর করার কথা। কিন্তু বিভাগীয় পরিচালক ও সিভিল সার্জনদের বেশিরভাগই এ দায়িত্ব পালন করেন না। তবে তারা নিয়মিত মোটা অঙ্কের উৎকোচ পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেনাকাটা, নিয়োগ-বদলি, টিএ/ডিএসহ নানাভাবে প্রতি মাসে স্বাস্থ্য খাতের কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে ওই লুটপাটের ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একশ্রেণির সিভিল সার্জন, বিভাগীয় পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার পকেটে নিয়মিত আসে। এ কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কোনো প্রতিকার হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিত্সকদের গ্রামাঞ্চলে থাকতে হবে এবং অসহায় মানুষের চিকিত্সাসেবা দিতে হবে এ ধরনের নির্দেশনা চিকিত্সকদের সভা-সেমিনারে বেশ কয়েক দফা দিয়েছেন। কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনাও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বাস্তবায়ন করেননি। বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তার পছন্দের প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষককে তদবিরের মাধ্যমে বদলি করে আনেন। এই প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষকের মাধ্যমে টিএ/ডিএসহ নানা ব্যয় দেখিয়ে স্বাস্থ্য খাতের কোটি কোটি টাকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেশিরভাগ কর্মকর্তা লুটপাট করে আসছেন। প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার টোল কালেক্টর হিসেবে পরিচিত। কর্মস্থলে মাসের পর মাস অনুপস্থিত থেকে একশ্রেণির চিকিত্সক স্থানীয় ক্লিনিকে কিংবা জেলা শহর ও রাজধানীতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে আসছেন। এই প্রাকটিসের টাকার ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মপ্লেক্সের প্রধান, সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পরিচালকের পকেটে নিয়মিত যায়।

এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাথরুম বছরের পর বছর পরিষ্কার করা হয় না। দুর্গন্ধ আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজমান বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও গরিব-দরিদ্র রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সরকারিভাবে সরবরাহকৃত ওষুধের বেশিরভাগই পাচার হয়ে যায়। ওইসব ওষুধ রোগীরা ফার্মেসি থেকে টাকা দিয়ে কিনছে এমন প্রমাণও পাওয়া যায়। বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেড রোগীশূন্য থাকে। অধিকাংশই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সই ৫০ অথবা ৩১ বেডের। এইসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত সকল বেডে ভর্তি দেখিয়ে খাবার সরবরাহের নামে চলছে পুকুর চুরি। সরেজমিনে এ প্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রতিনিধিগণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও চিকিত্সকদের অনুপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও দুই পরিচালকের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট বিগত পাঁচ বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির সাথে জড়িত। একজন পরিচালক একাধিক পদে রয়েছেন। সর্বশেষ তাদের বাণিজ্য হয় ১৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও একটি ডেন্টাল কলেজ থেকে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমোদন ছাড়াই ওই সিন্ডিকেট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় এবং সে প্রস্তাব অনুযায়ী কলেজগুলো অনুমোদন ভাগিয়ে নেয়। মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এই কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত, এমন অভিযোগও পাওয়া যায়। অধিদপ্তরের অধিকাংশ ফাইলে মহাপরিচালকের অনুমোদন না নিয়ে ওই সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন অনিয়ম করে আসছে। তাদের সাথে স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ ও বিএমএ’র কয়েক নেতা জড়িত। এই জন্য ওই সিন্ডিকেট গত পাঁচ বছর দোর্দণ্ড প্রতাপে অধিদপ্তরে একক আধিপত্য বিস্তার করেছে। এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসনে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকার করেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিত্সকদের অনুপস্থিতি, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের সাথে জড়িত ২৫০ জন চিকিত্সকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পরিচালক রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত আছে। এই কার্যক্রমের ফলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিত্সা সেবা কার্যক্রম পূর্বের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে বলে তিনি জানান।