দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা

স্টাফ রিপোর্টার: গ্যাসের দাম বাড়ানোর মাত্র ৩ মাসের মাথায় এবার বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাবকে শিল্প ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, দেশীয় শিল্পকারখানা ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধের মাধ্যমে দেশকে বড় ধরনের বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত চলছে। অপরদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, হাজার হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়ে এখন সেই টাকা সমন্বয় করতেই জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে ঘন ঘন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। তাদের মতে, সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্র বিপুল অঙ্কের দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্য করে পছন্দের কোম্পানিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। যাদের প্রকল্প ব্যয় বাস্তবতার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পকে ভুয়া হিসাব দেখিয়ে বানানো হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। যে কারণে বিদ্যুত উৎপাদন করতে সাড়ে ৫ টাকা খরচ হলেও প্রকল্প ব্যয় বেশি দেখানোর ফলে তাদের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট ৮ থেকে ১৫ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। সরকারও তাতে সায় দিচ্ছে। অথচ দেশের মধ্যে সবদিক থেকে সক্ষম কয়েকটি কোম্পানি এর চেয়ে কম দরে বিদ্যুত দিতে চাইলেও তারা সেসব প্রস্তাবে সাড়া দিচ্ছে না। আর এভাবে বিদ্যুত কিনতে গিয়ে বাড়তি বোঝা চাপানো হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। ৬ মাস অন্তর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চক্রান্ত শুরু হয়েছে। ফলে সবার আগে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের উৎপাদনমুখী বিভিন্ন শিল্পকলকারখানা। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছে শত শত প্রতিষ্ঠান। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের মধ্যে বড় বড় সফল বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প গড়ে উঠুক, তা চক্রান্তকারীরা চায় না। তারা চায়, বাংলাদেশ যেন গ্যাস-বিদ্যুতে কোনো দিন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না পারে। পরনির্ভরশীল করে জিম্মি করে রাখতে চায়। চক্রটি বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে, কিন্তু কম দামে বিদ্যুত দিতে পারে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেবে না।

এদিকে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শিল্প গ্রাহকরা গ্যাস-বিদ্যুৎ না পেলেও অবৈধ লাইনে গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব নেই। ক্যাপটিভ পাওয়ার স্টেশনে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে ইতিমধ্যে তিন হাজারের বেশি শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এবার বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়লে দেশীয় শিল্প আর থাকবে না। ৫ শতাংশ বাড়লেও কেউ কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবেন না। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, মাত্র ৩ মাস আগে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তখন আমরা অনেক বিরোধিতা করেছি। কিন্তু সরকার শোনেনি। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার জানা মতে অনেক দেশীয় উদ্যোক্তা আছেন, যারা অনেক কম দামে বিদ্যুত উৎপাদন করতে চান। কিন্তু সরকার তাদের দিচ্ছে না। অথচ যারা ১০ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বানিয়ে জমা দিয়েছেন তাদের এমন অসংখ্য প্রস্তাবও সরকার পাস করেছে। এর ফলে সরকার তাদের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনছে। মূলত এ কারণেই বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, তার জানামতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক দেশীয় উদ্যোক্তা ৬ টাকা দরে বিদ্যুত বিক্রির প্রস্তাব জমা দিয়েছে। কিন্তু সরকার ওইসব দেশীয় উদ্যোক্তদের সুযোগ না দিয়ে ৮টাকার বেশি দরে অনেক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছে। ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পকে ১০ হাজার কোটি দেখিয়ে কাজ নিয়েছে এমন নজিরও আছে এদেশে। মাঝখানে বিপুল পরিমাণ যে অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয় তার সবই দুর্নীতি। তার মতে, উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুত কেনার কারণে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। তার জানা মতে, কার্যাদেশ নিয়েও এখনও অসংখ্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে পারেনি। যে কয়টি উৎপাদনে এসেছে সেগুলোর অধিকাংশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। যে কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি এখনও ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তিনি মনে করেন, এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মূলত দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলেছেন, কিছু লোক সরকারকে ভুল বুঝিয়ে ৩ মাস আগে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। তাই আবার দাম বাড়ালে বস্ত্র খাতের অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তারা মনে করেন, এখনও সরকার প্রয়োজনীয় বিদ্যুত সরবরাহ করতে পারছে না। বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতি তো আছেই। এ অবস্থায় আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বাংলাদেশ। খোদ বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ রোববার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এখনও আড়াই হাজারের বেশি শিল্প কারখানা গ্যাস সংযোগের অপেক্ষায় চালু হতে পারছে না। আবার ২০১৮ সালের আগে সব শিল্প কারখানাকে গ্যাস দিতে পারবেন না। অপরদিকে গ্রামের মানুষের অভিযোগ, সেখানে এখনো গড়ে প্রতিদিন ৮/৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। কাজেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম যুগান্তরকে আরও বলেন, নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পেছনে যে পাঁয়তারা চলছে তাতে যেসব ব্যয় যোগ হওয়ার কথা নয়, তা-ও যোগ করে ওই খরচ জনগণের ওপর চাপাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। মনে হচ্ছে যেনতেনভাবে দাম বাড়াতেই হবে- এটাই হচ্ছে বিদুৎ বিভাগের লক্ষ্য। তিনি বলেন, এটা তো জনকল্যাণমূলক সরকারের কাজ হতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে কেন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মতো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারকে জনগণের কাছে আরও অপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে তা তার বোধগম্য নয়। হতে পারে, এটা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। কিন্তু সরকারের উচিত হবে, এসব ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কারণ সামনে নির্বাচন। এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে নির্ঘাত নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।