দু বছরে ব্যাংক খাত থেকে তিন হাজার কোটি টাকা গায়েব মন্দ ঋণের নামে রাইট অফ : জড়িত ব্যাংকের কর্মকর্তারাই

স্টাফ রিপোর্টার: দু বছরে ব্যাংক খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি গায়েব হয়ে গেছে। মন্দ ঋণের নামে ব্যাংকগুলো এ টাকা অবলোপন (রাইট অফ) করে দিয়েছে। ব্যাংক খাতে মন্দ হিসেবে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোরই ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির মন্দ ঋণ হিসেবে গায়েব হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। গত দু বছরেই সোনালী ব্যাংক থেকে গায়েব হয়েছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি।

সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনা উপেক্ষা করে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করছে। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়া হচ্ছে। টাকা মেরে দেয়ার তালিকায় শীর্ষ ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। সূত্রমতে, নীতিমালা ভঙ্গ করে এক বছরের মন্দ ঋণও অবলোপন করা হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালক, শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব ঋণ অবলোপন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোতে আদায়ের সময় উত্তীর্ণ হলে খেলাপি ঋণ শ্রেণিকরণ করে মন্দ হিসেবে (আদায় অযোগ্য) চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে ব্যাংক খাতে  খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দ ঋণের পরিমাণ ৩৭ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৮০ শতাংশই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকরণের সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে অবলোপন করে দেয়া হয়। যে ঋণ ব্যাংকের মূল হিসেব থেকে বাদ দেয়া হয়। এ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর সমপরিমাণ টাকা প্রভিশন হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংকখাতে অবলোপন ঋণ ছিলো ৩৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। পরবর্তী দু বছরে অর্থাৎ ২০১৪ ও ২০১৫ সালে অবলোপন করা হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের রয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য বিশেষায়িত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের রয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেরও ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অবলোপনকৃত ঋণ রয়েছে। সরকারি চার ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মন্দ ঋণ অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক। তাদের অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। অগ্রণী ব্যাংক ৫ হাজার ৫০৬ কোটি, জনতা ব্যাংক ৪ হাজার ৮০০ কোটি, রূপালী ব্যাংক ২ হাজার কোটি টাকার বেশি মন্দ ঋণ অবলোপন করেছে। অবলোপন করা মন্দ ঋণ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে মোট খেলাপির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। বিশেষায়িত চার ব্যাংকের মধ্যে অবলোপন করার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। ব্যাংকটি গত দু বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বেশি অবলোপন করেছে। এরপরে আছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। অবলোপন থেকে মুক্ত নয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোও। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা রয়েছে। সে আলোকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে। অবলোপনের পর মামলা হলেও তা আদায় নিয়ে নানা সংকট রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আমাদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগও আছে। সেসব অভিযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ঋণ মন্দ হিসেবে চিহ্নিত হলেও তা আদায় করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অবলোপন করতেই ব্যাংকের আগ্রহ বেশি। এর সাথে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাই জড়িত। গত কয়েক বছরে অবলোপনের হার কেনো বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। একই সাথে আর যেনো এমনভাবে অবলোপন করা না হয় সেদিকেও নজর রাখা উচিত।