দুর্নীতি মামলায় যাবজ্জীবন হয়েছিলো লতিফ সিদ্দিকীর

রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে গণমিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ

 

স্টাফ রিপোর্টার: ৭১ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে পুরান ঢাকার কলতাবাজারে দু মাস রিকশা চালিয়ে খেয়েছি। … টাকার অভাবে হোটেলে না থেকে বাহাদুর শাহ পার্কে রাত কাটিয়েছি। … অর্থাভাবে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারিনি। ভাইদের ভাতের ফেন খেয়ে বাঁচতে হয়েছে।

গত বছর ১৮ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মানহানি মামলার শুনানিতে কথাগুলো বলেছিলেন বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। এমন কথা তিনি টাঙ্গাইলের জনসভায় হরহামেশাই বলেন। তাদের বাস্তব অবস্থাও ছিলো তা-ই। সেই কাদের সিদ্দিকীরই বড় ভাই আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী। পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে কটুক্তি করায় তার বিচারের দাবিতে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে গণমিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করছে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, লতিফ সিদ্দিকীর বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী স্বাধীনতার আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টাঙ্গাইল শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় বসবাস শুরু করেন। তিনি পাট করপোরেশনে চাকরি করতেন সামান্য বেতনে। এ টাকা দিয়ে ছেলে লতিফ সিদ্দিকী ও আবদুল কাদের সিদ্দিকীসহ অন্য সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগান দিতে হিমশিম খেতে হতো। পরে আবদুল আলী সিদ্দিকী ওই চাকরি ছেড়ে দিলে দুর্নীতির মামলায় জেল খাটেন। ১৯৫৫ সালে তিনি মোক্তারি শুরু করেন টাঙ্গাইল আদালতে। সে সময়ও তার আর্থিক অবস্থা ছিলো খুবই করুণ। তখন দু স্ত্রী ও আট ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে পারেননি। সেই সময় লতিফ সিদ্দিকী ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করে পিতার সংসার থেকে কিছুটা দূরে চলে যান আর্থিক সংকটের কারণে। অন্যের আর্থিক সহায়তা নিয়ে মানুষ হয়েছেন তিনিসহ তার চার ভাই ও বোন।

তারা আরও জানান, লতিফ সিদ্দিকী এক সময় টাঙ্গাইল আর্টিজেনের পরিচালক হন। সেখানে তিনি সুতা বিক্রি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতির মাধ্যমে সুতা বিক্রির ঘটনায় তার নামে মামলা হয়। এ মামলায় ১৯৭৫ সালে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৩ বছর তিনি কারাগারেই কাটান। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের আমলে নির্বাচনে তার স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হন। এরপর এরশাদের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান লতিফ সিদ্দিকী। ১৯৯৬ সালে কালিহাতী থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই লতিফ সিদ্দিকীর ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার কয়েক মাসের মাথায় স্থান পান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামেও। এরপর থেকে মন্ত্রী তার নির্বাচনী এলাকা কালিহাতীসহ জেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, জমি দখল ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। কামিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। তার হস্তক্ষেপে জেলার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রকৃত ঠিকাদাররা অতিষ্ঠ। টাঙ্গাইলের মানুষের কাছে তিনি বড় দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ১৯৮৮ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্তও লতিফ সিদ্দিকীর দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস ছিলো না। তিনি জেলে থাকার সময় বন্ধু, রাজনৈতিক সহকর্মী ও অন্যদের অনুগ্রহেই তার সংসার চলেছে। ৯৬ সালের আগ পর্যন্ত তার কোনো বৈধ আয়ের উৎস ছিলো না। সেই লতিফের এখন কয়েক হাজার বিঘা জমি, গাড়ি, বাড়িসহ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তিনি বিদেশেও টাকা পাচার করেছেন।

এদিকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিচারের দাবিতে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে গণমিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করছে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন। তবে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয় ১১টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত
ইসলামী দলের ব্যানারে। এ সমাবেশ থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের আলটিমেটাম দিয়েছেন বক্তারা। অন্যথায় ২৬ অক্টোবর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি পালন করবে তারা। গতকাল জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ শুরু হয়। প্রথমে পুলিশ মসজিদের উত্তর গেটে বিক্ষোভকারীদের বাধা দেয়। তবে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তারা জুতো এবং ঝাড়ু হাতে নিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। লতিফ সিদ্দিকীর ফাঁসি দাবি করে। একই ইস্যুতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, মাদ্‌রাসা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, মুজাহিদ পরিষদ, খেলাফত মজলিস মিছিল সমাবেশ করেছে। বিকেলে আলাদা বিক্ষোভ সমাবেশ করে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন। এছাড়া লতিফ সিদ্দিকীর কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন বাংলাদেশ তরিকত  ফেডারেশনের মহাসচিব এমএ আউয়াল।

সমাবেশে মাওলানা জাফরুল্লাহ খান বলেন, ঈমান-আকিদা, পবিত্র হজ নিয়ে বিষোদগার এবং মহানবী (সা.) নিয়ে কটূক্তি করে লতিফ সিদ্দিকী নাস্তিক-মুরতাদদের কাতারে শামিল হয়েছেন। ওলি-আউলিয়াদের এ পবিত্র জমিনে কোনো নাস্তিক-মুরতাদের স্থান হবে না। তিনি আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে আত্মস্বীকৃত মুরতাদ লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শান্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। অন্যথায় ২৬ অক্টোবর তৌহিদি জনতা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করবেন বলে ঘোষণা দেন।