দুর্নীতির টাকা ফেরতে বিশ্ব নেতাদের উদ্যোগ

স্টাফ রিপোর্টার: পরিচয় গোপন কিংবা অর্থের উত্স না জানিয়ে সম্পত্তি কেনা যাবে না দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি কিংবা দেশ চিহ্নিত হবে সহজেই, বৃটেনে দুর্নীতিবাজদের জায়গা নেই: ক্যামেরন ‘দুর্নীতি-সন্ত্রাস নিরাপত্তার হুমকি বললেন জন কেরি ধনীদের জন্য লন্ডনে আর সম্পদ কেনা সহজ থাকছে না। বরং কেউ সেখানে সম্পদের মালিক হতে চাইলে সরকারি রেজিস্ট্রারের কাছে তাকে সম্পত্তির হিসাব লিপিবদ্ধ করতে হবে। অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ করতেই এমন উদ্যোগের ঘোষণা দিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। সম্প্রতি সেদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে দুর্নীতি বিরোধী সম্মেলন। এতে যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও। বিশ্বনেতৃবৃন্দ কালো টাকা, অবৈধ পথে অর্জিত বা অপ্রদর্শিত, পাচারকৃত অর্থের রাশ টেনে ধরতেই এমন উদ্যোগে সম্মত হলেন। আগামী বছর একই রকম সম্মেলন হবে যুক্তরাষ্ট্রে।

চুরি ও পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে ব্রিটেনের এই উদ্যোগে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, আফগানিস্তান। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জর্দান, ইন্দোনেশিয়া, আয়ারল্যান্ড, জর্জিয়ার মত দেশগুলোও একই রকম পদক্ষেপে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ৪০টি দেশের প্রতিনিধি ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মত আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরাও সম্মেলনে অংশ নেন। কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে এবং চুরির সম্পদ উদ্ধারে বৈশ্বিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজ দেশে থাকা কোম্পানিগুলোর প্রকৃত মালিকের তালিকা প্রকাশে একমত হয়েছেন ব্রিটেনসহ ৬ দেশের নেতারা। ক্যামেরনতো স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, তার দেশে কোনো দুর্নীতিবাজের জায়গা হবে না।

এই প্রথমবারের মতো এমন একটি সম্মেলনের আয়োজন এবং বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দেয়া হলো। ফলে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি কিংবা দেশ যুক্তরাজ্যের সম্পত্তির বাজার ব্যবহার করে সুবিধা নিতে পারবে না এমন নিশ্চয়তা দেশটির প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। খবর:বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ানের।

ব্রিটেনে দুর্নীতিবাজদের জায়গা নেই ডেভিড ক্যামেরন: বৃহস্পতিবার সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে ডেভিড ক্যামেরন বলেন, সাম্প্রতিককালে ব্রিটেন বিশেষ করে লন্ডনে বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার হিড়িক পড়েছে। এখানে বিদেশিরা সম্পদ কিনে প্রকৃত মালিকানা গোপন করছে যা খুবই উদ্বেগের। দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে। বিদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে অবৈধ অর্থ আসা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ব্রিটেনে থাকা বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে তাদের সম্পদের প্রকৃত তথ্য অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। যারা ইতোমধ্যে ব্রিটেনে সম্পদ কিনেছেন বা কেনার পরিকল্পনা করছেন তাদেরকে এই নিবন্ধন করতে হবে। এর ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সরে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। তিনি বলেন, বিদেশি কোম্পানি ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে এক লাখের বেশি সম্পত্তি কিনেছে। এর মধ্যে লন্ডনেই ৪৪ হাজারের বেশি সম্পত্তি বিদেশিরা কিনেছেন।

ক্যামেরন আরো বলেন, দুর্নীতি বিরোধী সম্মেলন থেকেই বিশ্বব্যাপী অর্থ চুরির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা হলো। ধনী-দরিদ্রের মাঝে সম্পদের বৈষম্য কমানো ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দুর্নীতি রোধে সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আমরা কয়েক বছর ধরে দুর্নীতির যে মহোত্সব দেখে আসছি, তার বিরুদ্ধে বিশ্ব নেতাদের সচেতন করতেই প্রথমবারের মতো এমন সম্মেলনের আয়োজন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। অর্থ চুরি ঠেকাতে ও দারিদ্র্য নির্মূল করতে, বিশ্বে কে কত সম্পদের মালিক, সব দেশকেই সে তথ্য প্রকাশ করতে হবে। তিনি দুর্নীতিকে ‘ক্যান্সার’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি আরো অনেক সমস্যার মূল কারণ। দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ তৈরিতে বিশ্বকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

দুর্নীতিবাজদের ধরতে বৈশ্বিক পরিকল্পনায় একমত ছয় দেশ: সম্মেলনে অর্থ পাচার রোধে নতুন এই পরিকল্পনার কথা জানায় যুক্তরাজ্য। দুর্নীতি মোকাবিলায় ব্রিটেনের পাশাপাশি ফ্রান্স, কেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া  এবং আফগানিস্তান তাদের দেশে থাকা কোম্পানির প্রকৃত মালিকদের বিষয়ে তথ্য প্রকাশে সম্মত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জর্দান, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো ছয়টি দেশ একই পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে। দুর্নীতি ও কর ফাঁকির বিরুদ্ধে আন্তঃযোগাযোগ বাড়াতে সম্মেলনে অংশ নেয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৩৪ দফার একটি খসড়া সমঝোতা হয়। এ ছাড়া লন্ডনে একটি নতুন আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সমন্বয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে।

দুর্নীতি-সন্ত্রাসবাদ নিরাপত্তার হুমকি: জন কেরি সম্মেলনে অংশ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদ বৈশ্বিক অর্থনীতি নিরাপত্তার জন্য বড় যৌথ হুমকি। ওবামা প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির মহোত্সব দেখে আমি হতাশ। তিনি বলেন, আমাদের সবাই একটি যুদ্ধে লড়াই করছি। সেটা হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কারণ এটি একটি দেশ, জাতিকে ধ্বংস করে দেয়। দুর্নীতিবাজদের কোনো নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র থাকতে দেয়া হবে না। এর অর্থ যখন কেউ তোমার দেশ থেকে চুরি করে আমার দেশে রাখবে তখন আমরা তা প্রকাশ করে চুরির অর্থ ফেরত দেব। এটাই আমাদের মিশন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমরা আজ কেবল শুরু করেছি।

সম্মেলনে নাইজেরিয়া, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানরাও বক্তব্য রাখেন। নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুহারি বলেন, দুর্নীতি মোকাবিলা তার সরকারের দায়িত্বের প্রধান লক্ষ্য। চুরি বা তথ্য গোপন করে গচ্ছিত সম্পদ ফেরত আনতে তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। আফগান প্রেসিডেন্ট ঘানি বলেন, দুর্নীতি তার দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছে। নেতারা বলেন, নাম প্রকাশের পর দুর্নীতিতে জড়িতদের শাস্তি প্রদানে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার পদক্ষেপ নিতে হবে। যখন দুর্নীতিবাজদের নাম প্রকাশ করা হবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের সম্পদ জব্দ করার জন্য আমাদের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যে দেশ থেকে এই সম্পদ চুরি করেছে সে সব দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সমন্বয় কেন্দ্র পুলিশ ও আইনজীবীদের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে হবে।