দুদক এখন আর দুর্নীতি দমন কমিশন নয় দুর্নীতির কমিশনে পরিণত হয়েছে : খালেদা

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে আজ ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, গুম-খুন হত্যা আওয়ামী লীগের প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তারা জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে। দেশকে নিয়ে খেলছে। এটা হতে দেয়া হবে না। সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই নব্য মীরজাফরকে বিদায় করা হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। গতকাল বুধবার কিশোরগঞ্জে ২০ দলীয় জোটের জনসভায় বিএনপি প্রধান এ কথা বলেন। এ সময় দমন-পীড়নের অভিযোগ তুলে তিনি সরকারকে হুশিয়ার করে দেন। প্রতিরোধের ডাক দিয়ে তিনি বলেন, বেশি অত্যাচার-নির্যাতন হলে ঈসা খাঁর ঢাল-তলোয়ারের কথা আপনাদের মনে আছে। আপনারা তা বুঝে নেবেন। আমি যখনই আন্দোলনের ডাক দেব, আপনারা অতীতের মতো সাড়া দেবেন।’

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, বাংলাদেশে মীরজাফররা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে। এখনও মীরজাফররা বিএনপিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। আমি বলতে চাই, এদেশে মীরজাফর যেমন আছে, সিরাজউদ্দৌলাও আছে।

গুম করে মানুষ হত্যার জন্য র‌্যাব এবং বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে গুলিবর্ষণের জন্য পুলিশকে দায়ী করে খালেদা জিয়া ওই দুটি সংস্থাকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ না দিতে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান। স্থানীয় গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচন, গুম-খুন-গুপ্তহত্যা-দুর্নীতির প্রতিবাদে এ জনসভা হয়। ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর ঢাকার বাইরে এটি খালেদা জিয়ার অষ্টম জনসভা। সর্বশেষ ১ নভেম্বর নাটোরে ২০ দলীয় জোটের জনসভায় বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া।

বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে সরকার বাধার সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিলে কর্মসূচি দেয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকবে না। যে কর্মসূচি দেব আশা করি, আমার আহ্বানে আপনারা সাড়া দেবেন।

বিএনপি প্রধান বলেন, দেশে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ- এই তিন বাহিনী এখন ভয়াবহ বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। তারা সব লুটপাট করছে, জমি-জমা দখল করছে। মানুষ খুন করছে। এদের কোনো বিচার হয় না। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের পাহারায় এরা অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফিরা করছে। কিশোরগঞ্জ ছাড়াও নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, নরসিংদীর বিভিন্ন উপজেলা থেকেও ২০ দলের নেতাকর্মীরা জনসভায় যোগ দেন। তিনি আরও বলেন, সরকার দেশে দুর্নীতিকে বৈধতা দিচ্ছে অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, দুদক এখন আর দুর্নীতি দমন কমিশন নয় দুর্নীতির কমিশনে পরিণত হয়েছে। এদের বিদায় করতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতারা দুর্নীতি করলেও তাদের দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী নিজে বলেছেন, দুর্নীতি করা কোনো অন্যায় নয়। এর মানে দুর্নীতিকে আজ বৈধতা দেয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বয়স্ক লোক। মাঝে মাঝে সত্য কথা বলেন। ব্যাংকগুলোতে দলীয় লোক ও অযোগ্যদের বসানোর কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি রোধে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তিনি বলেননি আমি ব্যর্থ হয়েছি। তার মানে সরকার ব্যর্থ।

তিনি বলেন, ৭ নভেম্বর উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে প্রতিদিনই সভা সমাবেশ হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়া আমার কাছে বড় নয়। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়াই আমার লক্ষ্য। আমি ক্ষমতা চাই না, জনগণের সঙ্গে থাকতে চাই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন আমাকে অনেকবার বলেছে, আপনি ছেলেদের নিয়ে দেশ থেকে চলে যান। কিন্তু আমি বলেছি, কেন যাব? বিদেশে আমার কেউ নেই। এ দেশেই আমার শেষ ঠিকানা। আমি এদেশের জনগণের সঙ্গে থাকতে চাই। বিদেশে যায়নি বলে আমাকে এক বছর আট দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু অন্যজন জীবনের ভয়ে (হাসিনাকে ইঙ্গিত করে) চলে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি অনেক অপকর্ম করেছিলেন। তার দুর্নীতি ও অপকর্মের কথা তার ভাই (শেখ ফজলুল করীম সেলিম) ও জলিল সাহেব (আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক) স্বীকার করেছেন। এসব আমাদের কাছে আছে, একদিন তা প্রকাশ করা হবে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি হয়েছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আইনশৃংখলা পরিস্থিতির এ ভয়ানক অবস্থার জন্য আওয়ামী লীগ ও পুলিশ জড়িত। পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এরা প্রতিনিয়ত দুর্নীতি ও অনিয়ম করছে। মানুষের সেবক না হয়ে তারা মানুষ হত্যা করছে। কিন্তু এদের কিছুই বলা হচ্ছে না। ডিবি দিয়ে সরকার কন্ট্রাক্ট কিলিং করাচ্ছে। র‌্যাব মানুষ হত্যা করছে। এরা এখন মানুষ খুন করার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তরুণদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা।

র‌্যাব-পুলিশ তার দলের ৩১০ জনকে খুন ও ৫৬ জনকে গুম করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। বিএনপি নেত্রী সবাইকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে আবারও র‌্যাব বাতিলের দাবি জানান। খালেদা জিয়া বলেন, যে র‌্যাব-পুলিশ দেশের মানুষকে গুলি করে মারছে, জঙ্গি বা সন্ত্রাসী দমনে নয়, বিরোধী দল দমনে এ গোলাবারুদ ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশীদের বলব এসব অস্ত্র গোলাবারুদ আপনারা বিক্রি করবেন না।

সরকারের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাস্তাঘাটের দুরবস্থা। কিশোরগঞ্জে আসতে শরীর ব্যথা হয়ে যায়। কিশোরগঞ্জ থেকে এ পর্যন্ত তিনজন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাদের পুত্ররাও এখন ক্ষমতায় আছেন। কিন্তু কিশোরগঞ্জে কোনো উন্নয়ন হয়নি। যারা দেশের জন্য কাজ করে না তারা যতই নিজ এলাকার লোক হোক না কেন তাদের ভোট দিয়ে লাভ নেই।

তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সেই উন্নয়নের লিস্ট বলতে গেলে সময় শেষ হয়ে যাবে, অন্য কোনো কথা বলা যাবে না। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি হচ্ছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ডাক্তার নিয়োগ ও বদলিতে টাকা নেয়া হয়। উপজেলায় কোনো ডাক্তার থাকে না। ওষুধ পাওয়া যায় না। আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এক মন্ত্রী, তিনি পুলিশ বিভাগকে ধ্বংস করেছিলেন। এখন তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছেন।

বিচার বিভাগ সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে এমন অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, দেশের মানুষ আজ ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। দুই রকমের বিচার চলছে। সরকারি দলের জন্য একরকম আর বিরোধী দলের জন্য আরেক রকম। ওয়ান-ইলেভেনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা হলেও তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ একই সময়ে করা আমার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। আওয়ামী লীগের আট হাজার মামলা প্রত্যাহার হলেও বিরোধী দলের কোনো মামলা প্রত্যাহার হয়নি। বিচারকরা সঠিকভাবে রায় দিতে পারছে না। চাকরি থেকে বিদায় করতে আইন করা হচ্ছে। তাই ভয়ে তারা রায় দিতে পারছে না।

বিচারপতিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সঠিকভাবে বিচার করুন। না হলে পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ন্যায়বিচার না করলেও জনগণ আপনাদের ছাড়বে না। দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই উল্লেখ করে আবারও যুগান্তরের একটি খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, বিনিয়োগের ১১ বাধা। বিনিয়োগ করলে চাঁদা চাওয়া হচ্ছে। চাঁদার জন্য অস্ত্র নিয়ে ক্যাডাররা ঘুরে বেড়ায়। এ কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। গার্মেন্ট শিল্পে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। আবাসন খাতে ধস নেমেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগের অভাবে রি-হ্যাব কোনো ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারছে না। ব্যাংক ঋণের কারণে তারা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।