দুই বছরের মাথায় অবকাঠামো খাতের সাফল্যের বড় উদাহরণ পদ্মা সেতু

স্টাফ রিপোর্টার: দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার দুই বছরের মাথায় অবকাঠামো খাতের সাফল্যের বড় উদাহরণ পদ্মা সেতু প্রকল্প। এর মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। অবকাঠামো খাতের অন্য প্রকল্পও চলমান, তবে এগোচ্ছে ধীরগতিতে। দ্বিতীয় মেয়াদে সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ছিলো অবকাঠামো উন্নয়নে। এজন্য বেশ কিছু বড় প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়। দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িতব্য বা ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের একটি তালিকাও করা হয়। গুরুত্ব দেয়া হয় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিকেও (পিপিপি)।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে গতি সঞ্চালক প্রকল্প। আর দুই বছর ধরে তিনি এও বলেছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নকে উৎসাহিত করা হবে। এতেও কেউ জোরেশোরে উৎসাহ দেখাননি। শুধু ফাস্ট ট্র্যাক বা পিপিপি নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনসহ সাধারণভাবেও কিছু কাজ চলমান রয়েছে। এগোচ্ছে এগুলোও। এর মধ্যে চট্টগ্রাম চার লেনের গতি ধীর। ঢাকার রাস্তায় সম্প্রতি অবশ্য মেট্রোরেলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চোখে পড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেনের কাজ দ্রুততম সময়েও শেষ করার কথা বলা হয়।
তবে অবকাঠামো উন্নয়নে খুব বেশি এগোয়নি বাংলাদেশ। গত অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, অবকাঠামোর দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, গোটা এশিয়ার মধ্যেই বাংলাদেশের অবস্থান খারাপ। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে কেবল নেপাল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন গত নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠকে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি বলেন, মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে প্রতিবছর অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন জিডিপির ৮ থেকে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের এই বিনিয়োগ বর্তমানে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলো সরকার আগামী ৩ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম তদারক করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে এযাবৎ ছয়টি অগ্রগতি পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ মাসে হবে আরেকটি বৈঠক। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আড়াই লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেই ব্যয় হবে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। অন্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা সমুদ্রবন্দর, ঢাকা ম্যাস র্যা পিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট (মেট্রোরেল) এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) টার্মিনাল নির্মাণ। যোগাযোগ করলে সাবেক সচিব ও বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা এম ফাওজুল কবির খান বলেন, উন্নয়ন-সহযোগী, সরকার ও বেসরকারি খাত এই তিন উৎস থেকে অর্থ নিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হয়। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধের পর উন্নয়ন-সহযোগীরা অবকাঠামো খাতে অর্থায়নে কেমন যেন পিছিয়ে থাকছে। করণীয় কী, জানতে চাইলে ফাওজুল কবির বলেন, পিপিপি একটি ভালো পন্থা। কিন্তু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মনে হয় আস্থার সঙ্কট রয়েছে। সরকারকে এই সংকট দূর করার উপায় খুঁজতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে হলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়নের উৎস ঠিক হয়নি এখনো। তবে ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের মেট্রোরেলের জন্য বেশির ভাগ অর্থ দিচ্ছে জাপান। আর তিন পর্যায়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সময়কাল ২০৫০ সাল পর্যন্ত। এর অর্থায়নের উৎসও সরকারের অজানা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে পায়রা বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে এর মূল কাজ শুরু হয়নি এখনো। রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের শুধু জমি চিহ্নিত হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প ব্যয়ও ঠিক হয়নি। পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণ, মালিকানা, পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওওটি); নির্মাণ, পরিচালনা ও হস্তান্তর (বিওটি) এবং নির্মাণ, মালিকানা ও পরিচালনা (বিওও) এ তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ব্যাপারেও পিছিয়ে।
পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে গঠন করা হয়েছে পিপিপি কর্তৃপক্ষ। কী করছে এই কর্তৃপক্ষ, জানতে গতকাল যোগাযোগ করা হয় সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ আফসর এইচ উদ্দিনের সাথে। তিনি কথা বলার দায়িত্ব দেন উপসচিব আবুল বাশারকে, যিনি সংস্থার বিনিয়োগ-বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আবুল বাশার জানান, এ পর্যন্ত ৪৭টি প্রকল্প অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে বড় প্রকল্প হচ্ছে ২৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বেসরকারি খাত পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছে জানিয়ে বাশার বলেন, লন্ডন, ঢাকা ও সিলেটে তিনটি পিপিপি সম্মেলন করার পর সামিট, অরিয়ন, ইউনাইটেড গ্রুপসহ দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী, অনাবাসী বাংলাদেশি এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোও যোগাযোগ করছে। আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের অন্যতম আকর্ষণের বিষয় হবে পিপিপি। গত কয়েক বছরে যার ক্ষেত্র তৈরি হলো।