দুই পক্ষের আইনজীবীদের কর্মসূচি নিয়ে উত্তেজনা

প্রসঙ্গ: ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়

 

স্টাফ রিপোর্টার: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের পক্ষে-বিপক্ষে রাজধানীর পাশাপাশি এবার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে জেলা আইনজীবী সমিতিগুলোতেও। একদিকে রায়ে সংক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন মন্ত্রী-নেতা আদালতের পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয়ের ও প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সমালোচনা করছেন, অন্যদিকে রায় ও পর্যবেক্ষণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচকদের পাল্টা সমালোচনা করছে বিএনপিসহ সমমনারা। গত কয়েকদিন ধরে দুই পক্ষের এই বাহাস রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকলেও আজ রোববার থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশের বারগুলোতে। আর এই উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের তিনদিনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে ঘিরে।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও পর্যবেক্ষণের প্রতিবাদে আজ রোববার এবং আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ সারা দেশের আইনজীবী সমিতিগুলোতে ‘প্রতিবাদ সমাবেশ’ করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ’। গতকাল রাজধানীর ধানণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। অপরদিকে, তিন দফা দাবিতে ওই তিন দিনেই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ সারাদেশে জেলা বারসমূহে ‘বিক্ষোভ’ কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন ‘জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম’। আগেরদিন শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনের মহাসচিব ব্যারিস্টার এম মাহবুবউদ্দিন খোকন। বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের ‘বিক্ষোভ’-এর পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের ‘প্রতিবাদ সমাবেশ’ করার ঘোষণায় ঢাকার উত্তেজনা আজ থেকে বিস্তৃত হচ্ছে ৬৪ জেলা বারে।

ঢাকাসহ সারাদেশে বারগুলোতে দু পক্ষের পাল্টা কর্মসূচিকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম গতকাল বলেন, ‘দেশের জেলা আইনজীবী সমিতিগুলোতে ৯০ ভাগ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্যরা নেতৃত্বে রয়েছে। আমাদের ডাকা এই কর্মসূচি তারা কার্যকরভাবে পালন করবেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতেও আমরা এই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করব।’

শ ম রেজাউলের আগে আলাপকালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার এম মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই সরকারের মন্ত্রীরা বক্তব্য রাখছেন। এছাড়া সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকও রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এসব বক্তব্যের প্রতিবাদেই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ সকল জেলা বারে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। জেলা বারগুলোতে আমাদের ৭০ ভাগ নেতৃত্ব রয়েছে।’

আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণের পক্ষে-বিপক্ষে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এই রায় অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। যারা রায়ে সংক্ষুদ্ধ হবেন তারা রিভিউ করতে পারেন। আর যারা রায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে উল্লাস করছেন এটাও ভালো দিক নয়। আইনমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে রায়টি তারা খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করছেন এবং রায়ের যেসব বিষয় পছন্দনীয় নয় তা আইনিভাবে মোকাবেলা করবেন। কিন্তু রায় নিয়ে দুই পক্ষের কর্মসূচি বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিত করবে। সর্বোচ্চ আদালতের রায় সকলকে মানতে হবে; যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি পরিবর্তন, পরিমার্জন বা সংশোধন না হয়। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ওই রায় মানা আমাদের সকলের জন্য বাধ্যতামূলক।’

বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব শেখ ফজলে নূর তাপস গতকালের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি যেসব অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা দেশের আইনজীবী সমাজকে সংক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সংসদ এবং অধস্তন আদালতের প্রতি রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।’

ব্যারিস্টার তাপস বলেন, রায় নিয়ে একটি দল ও মহল বিচারাঙ্গনকে বিতর্কিত করার পাঁয়তারা করছে। আমরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। সংসদকে হেয় করা মানেই গণতন্ত্রকে হেয় করা, জনগণকে হেয় করা। আমরা আইনজীবী অঙ্গন এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। রায়ে যে সমস্ত ‘আপত্তিকর, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অপ্রাসঙ্গিক’ পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সেগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা।

অন্যদিকে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা যেই তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে সেগুলো হল- সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হকের অপসারণ ও গ্রেফতার, মন্ত্রীদের বক্তব্যের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের প্রতিবাদ এবং নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির বিধিমালার গেজেট অবিলম্বে প্রকাশ। শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেছেন, যারা আইনের শাসন, সংবিধা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন তারা সবাই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবেন। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের প্রত্যেক জেলা বারের নেতাদের কর্মসূচি সর্বাত্মক পালনের আহবান জানান তিনি।

ব্যারিস্টার খোকন আরও বলেছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বলেছেন যে- বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পরে তাদের কোনো সরকারি দায়িত্ব নেয়া উচিত নয়। তিনি নিজেই নিজের রায় ভঙ্গ করে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন। সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যেসব পদ সাংবিধানিক পদ আছে সেগুলোর শপথের কথা বলা আছে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের শপথের কোনো বিধান নেই। চেয়ারম্যান প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী মাত্র। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তার বক্তব্যে সীমাবদ্ধতা আছে, কোড অব কন্ডাক্ট আছে। কোড অব কন্ডাক্ট অনুযায়ী তিনি সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন না, তিনি চাকরির শর্ত ভঙ্গ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমাদের সুপ্রিম কোর্টকে বিতর্কিক করেছেন। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সমালোচনার মাধ্যমে শপথ ভঙ্গ করেছেন। এসবের প্রতিবাদেই বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে বলে জানান ব্যারিস্টার খোকন।

আলোচিত এই রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি গত সপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন ডাকার পর সেখানে দুই পক্ষের আইনজীবীদের হট্টগোল বাধে। এখন সারাদেশের বারগুলোতে দুই পক্ষের আইনজীবীদের পাল্টা কর্মসূচিকে ঘিরে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।